অনিশ্চিতের গর্ভে বাংলার বেলাভূমি
ক দিকে বাঁধ দিলে অন্য দিকে শুরু হয়ে যাচ্ছে ভাঙন। ক্ষয়ে যাচ্ছে বালিয়াড়ি, বসে যাচ্ছে তটভূমি। মন্দারমণি থেকে শুরু করে উদয়পুর বঙ্গোপসাগরের তীরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এখন শুধু যেন বিপন্নতার ছবি, আর অনিশ্চিতের আশঙ্কা!
দক্ষিণে সুন্দরবন কিংবা মুর্শিদাবাদ-মালদহের অপ্রতিরোধ্য নদী ভাঙন যেমন কোটি কোটি টাকা খরচ করেও রোখা যায়নি, তেমনই দিঘা-মন্দারমণির সাগরতটও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে তিন তিল করে। কোথাও চোখের সামনে। কোথাও বা নিভৃতে সমুদ্রতীরের তলদেশ কেটে একটু-একটু জমি নিজের গর্ভে টেনে নিচ্ছে বঙ্গোপসাগর। দিঘায়, শঙ্করপুরে, উদয়পুরে।
রাজ্যের অন্যতম ওই সব পর্যটনস্থলকে কী ভাবে ভাঙনের হাত থেকে বাঁচানো যায়, তা নিয়ে সমীক্ষা কম হয়নি। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বহু প্রস্তাব দিলেও কার্যকর কোনও ব্যবস্থা হয়নি। উপরন্তু বিভিন্ন সমীক্ষায় ইঙ্গিত, মন্দারমণি-তাজপুরের ভবিষ্যৎও প্রাকৃতিক ওই ধ্বংসলীলার সামনে অসহায়। সম্প্রতি এক সেচ-সমীক্ষায় প্রকাশ, ওল্ড দিঘার শুরু থেকে মোহনা পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার এবং মোহনার পরে শঙ্করপুর-জলদা হয়ে মন্দারমণির আগে পর্যন্ত প্রায় দশ কিলোমিটার ভাঙনের কবলে পড়েছে।
সম্প্রতি দিঘা সৈকতে বাঁধের কাজ দেখতে যান সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
প্রশাসন কী ভাবছে?
রাজ্যের নতুন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে হয়েছে, “এই মুহূর্তে ওল্ড দিঘা ও উদয়পুরে পাড় সংরক্ষণকারী কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। না-হলে আসন্ন বর্ষায় বিরাট এলাকা জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে পারে।’’ রাজ্য সরকার তাই ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্যে নতুন করে বাঁধ ও পাড় রক্ষার পরিকাঠামো তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন রাজীববাবু। আপাতত ওল্ড দিঘায় বাঁধ মেরামতি ও উদয়পুর-শঙ্করপুর-জলদায় নতুন বাঁধ হচ্ছে। কোথাও পুরনো বাঁধে বোল্ডার ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। আবার ওল্ড দিঘা থেকে উদয়পুর পর্যন্ত সি-ওয়াল বরাবর গড়ে উঠছে মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভের আদলে একটি রাস্তা। সেচ-কর্তাদের দাবি, তা এক দিকে যেমন দিঘার পর্যটন-আকর্ষণ বাড়াবে, তেমন বাঁধেরও কাজ করবে।
কিন্তু এ সবই চলছে গতানুগতিক পদ্ধতিতে। বস্তুত তটরক্ষায় বিশেষ কোন প্রযুক্তি কার্যকর হবে, তা নিয়ে সেচ-কর্তারা কিছুটা বিভ্রান্ত। সমুদ্র-বিজ্ঞানীরদের একাংশও চলতি পদ্ধতির কার্যকারিতা সম্পর্কে বিশেষ আশাবাদী নন।
যদিও তাঁরাও নির্দিষ্ট কোনও দিশা দিতে পারেননি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র-বিজ্ঞানী গৌতম সেনের বক্তব্য, “দিঘায় পাড় সংরক্ষণের হাল ভাল নয়। অবিলম্বে ব্যবস্থা না-নিলে জলোচ্ছ্বাসে জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা।” সমুদ্র-বিজ্ঞানী সুগত হাজরা মনে করেন, সমুদ্রের সমান্তরাল বাঁধ দিয়ে তট বাঁচানো যাবে না। “আমার মনে হয়, দিঘা-উদয়পুরের কাজটা পণ্ডশ্রম হবে।” মন্তব্য তাঁর।

ত্রিসঙ্কটে সৈকত
বিপন্ন বাঁধ
তা হলে উপায় কী?
সেচ-কর্তারা জানাচ্ছেন, ক’বছর আগে চেন্নাই আইআইটি’র ওশান ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তরফে ওল্ড দিঘায় সমীক্ষা হয়েছিল। সমীক্ষা-রিপোর্টের সুপারিশ: দিঘার সৈকত বাঁচাতে গেলে তটভূমি থেকে সমুদ্রের গভীরে উল্লম্ব বাঁধ দিতে হবে। বোল্ডার-কংক্রিটে তৈরি লম্বালম্বি সেই বাঁধের দৈর্ঘ্য সব জায়গায় এক থাকলে চলবে না। এতে সমুদ্রতট বাঁচলেও বাঁচতে পারে। সেচ দফতর এখন ওই কাজে হাত দেবে বলে জানিয়েছেন রাজীববাবু। তাঁর কথায়, “২০০২-০৩ সালে দিঘা মোহনায় ভাঙন রোধে এমনই একটা বাঁধ তৈরি হয়েছিল, যা আজও অভিঘাত কমাতে সাহায্য করছে। ১৬ কিলোমিটার অংশে উল্লম্ব বাঁধ বানাতে প্রায় ১০৫০ কোটি টাকা লাগবে। বিশ্বব্যাঙ্কের সহায়তায় প্রকল্পটি রূপায়ণের পরিকল্পনা রয়েছে।”কিন্তু উদ্যোগটি নিয়ে প্রশ্নতুলেছেন সমুদ্র-বিজ্ঞানীদের অনেকে। সুগতবাবুর দাবি, “যেখানে উল্লম্ব বাঁধ দেওয়া হবে, শুধু সেই জায়গাটা বাঁচবে। তবে অন্যত্র ভাঙন হবে।” তাঁর মতে, জনজীবন সুরক্ষিত রাখতে হলে বালিয়াড়ির পিছনে সমুদ্র-বাঁধ তোলা দরকার। তা ছাড়া সমুদ্রের তলা থেকে বালি তুলে এনে সৈকতে ফেলা গেলে একটা দীর্ঘস্থায়ী সুরাহা হতে পারে বলে সুগতবাবু মনে করছেন। এমন হরেক তত্ত্ব-মতের জটে প্রায় দিশাহীন পড়ছে সাগরপাড়ের সংরক্ষণ-প্রক্রিয়া। সেচ-অধিকারিকেরা জানিয়েছেন, আশির দশকের শেষাশেষি নিউ দিঘায় ভাঙনের সূচনা। তা প্রতিরোধে সেখানে ল্যাটেরাইট বোল্ডার ফেলা হয়েছিল, পরে যার উপরে বালি জমে জমে রীতিমতো ‘বিচ’ তৈরি হয়ে গিয়েছে। সৈকত-সফরের আমেজ নিতে আপাতত নিউ দিঘার ওটুকু অংশই পর্যটকদের সম্বল। ওল্ড দিঘায় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি শুরু হওয়া ভাঙন অবশ্য আজও অব্যাহত। আর ১৯৯৫-৯৬ সালেও শঙ্করপুরের সম্পদ ছিল সাদা বালির যে বিস্তৃত চোখ-জুড়ানো বেলাভূমি, বিগত দশকে তাতেও লেগেছে ক্ষয়ের আঁচ।
সাগরতটে এ হেন আগ্রাসী ভাঙনের কারণ কী?
এ ক্ষেত্রে দখলদারি এবং সৈকতে বালি না-জমার দিকেই মূলত আঙুল তুলছেন সমুদ্র-বিজ্ঞানী ও সেচ-কর্তারা। তাঁদের ব্যাখ্যা: ১৮৭০-এ দিঘা থেকে হলদি নদীর মোহনা পর্যন্ত ব্রিটিশরা যে মাটির বাঁধ বানিয়েছিল, তার সিংহভাগ মাছ-চাষের জন্য দখল হয়ে যাওয়ায় বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সেখানে অবাধে আঘাত হানছে সমুদ্র। অন্য দিকে ঝাড়খণ্ডে চান্ডিল-সহ বেশ ক’জায়গায় সুবর্ণরেখা নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে নদী আর যথেষ্ট পরিমাণ বালি বয়ে আনতে পারছে না। তাই সাগরতটে বালি জমছে কম। যেটুকু জমছে, তার বেশিটাই ঢেউ এসে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে।সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বেলাভূমির রক্ষাকবচও।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.