ইউরোপের সম্রাট
বায়ার্নের শাপমোচন ঘটাল
রবেনদের ডাইরেক্ট ফুটবল
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের পরের দিন একটা বিখ্যাত ফুটবল ওয়েবসাইটে এ মরসুমের টুর্নামেন্টের সেরা একাদশ দেখছিলাম। দুই ফাইনালিস্টের মাত্র চার ফুটবলার সুযোগ পেয়েছে। চ্যাম্পিয়ন বায়ার্নের তিন জন। ইউরোপিয়ান কোচেদের ইদানীং যেটা খুব পছন্দের ফর্মেশন সেই ৪-২-৩-১ ছকে ডিফেন্সে লাম আর মাঝমাঠে সোয়াইনস্টাইগার ও রবেন। রানার্স বরুসিয়ার মাত্র এক জন হ্যামস্ট্রিং চোটে শনিবার রাতের ফাইনালে না খেলা গোটজে। অথচ কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নেওয়া জুভেন্তাসের তিন জন সেরা একাদশে রয়েছে!
লেখার শুরুতেই এটা জানিয়ে এই নয় যে, ওয়েম্বলির ফাইনালে বায়ার্নের ২-১ জয়কে আমি কোনও ভাবে খাটো করতে চাইছি।

ট্রফি নিয়ে টিম-বায়ার্ন।
বরং দ্বিতীয়ার্ধে মান্ডজুকিচের গোল আট মিনিটের মধ্যে ন্যায্য পেনাল্টি থেকে গুন্দোগান শোধ করে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে যে ভাবে ম্যাচে ফেরত এনেছিল, তার পর ভাবাই যায়নি মাত্র এক মিনিট বাকি থাকতে রবেনের গোলে বায়ার্ন মিউনিখ নব্বই মিনিটেই ট্রফি তুলে নেবে! যতই ফাইনালের আগে বালাক বা জিদানের মতো গ্রেট ফুটবল ব্যক্তিত্বও বায়ার্ন জিতবে বলে থাকুক। বরং জার্মান টেনিস কিংবদন্তি বরিস বেকারের অভুতপূর্ব ফুটবল বিশ্লেষণকে বোধহয় সেলাম করা উচিত। বায়ার্নের ম্যাচ উইনার রবেন সম্বন্ধে ফাইনালের আগে বেকারের মন্তব্য ছিল, “ও পরশপাথর। যা ছোঁয় সেটাই সোনা হয়ে যায়।” সত্যিই, গোটা ম্যাচ জুড়ে একগাদা সুযোগ নষ্ট করেও ওস্তাদের মার দেখিয়ে ঠিক সময়ে উইনিং গোল করল! বায়ার্নের প্রথম গোলের ক্ষেত্রেও রবেনের মাইনাস-এর কৃতিত্বই আশি ভাগ। মান্ডজুকিচের গোল করার কৃতিত্ব কুড়ি ভাগ।
বায়ার্নের ইউরোপ সেরা হওয়ার পাঁচটা বিশেষত্ব খুঁজে পাচ্ছি।
এক) শেষ তিন বছরে দু’বার ফাইনালে (২০১০-এ ইন্টার মিলান, গত বছর চেলসির বিরুদ্ধে) হারার পর এ বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রচণ্ড স্বস্তি পেয়েছে সোয়াইনস্টাইগার, লাম-রা।

পার্টিতে উদ্দাম নাচ বায়ার্ন
কোচ হেইনকেসের সঙ্গে।

বান্ধবীকে গভীর চুম্বন
সোয়াইনস্টাইগারের।
দুই) পারফেকশনের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছনো। ২০১২-র চ্যাম্পিয়ন চেলসির খেলা ছিল কাউন্টার অ্যাটাক ভিত্তিক। ২০০৯ আর ২০১১-র চ্যাম্পিয়ন বার্সেলোনার পাস-পাস-পাস খেলা এক-এক সময় বল পজেশন আর গোলে অ্যাটাকের মধ্যে প্রচুর বাড়তি সময় নিত। বায়ার্নের সেখানে বল পজেশন আর গোলে আক্রমণের মধ্যে সময়ের ব্যবধান অনেক কম। অনেক বেশি ডাইরেক্ট ফুটবলের নিদর্শন। আবার ডিফেন্সিভ গেমও অসাধারণ। কোয়ার্টার আর সেমিফাইনালে জুভেন্তাস এবং বার্সেলোনার মতো মহাশক্তির বিরুদ্ধে ৩৬০ মিনিট নিজেদের গোল অক্ষত রাখার পাশাপাশি বায়ার্ন মোট ১১ গোল করেছে।
তিন) সেরাদের হারিয়ে সেরা হয়েছে। চ্যাম্পিয়ন হতে জুভেন্তাসকে ৪-০, বার্সেলোনাকে ৭-০ গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
চার) চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে অন্য টুর্নামেন্টে খারাপ করেনি। ২০০৫-র চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল সে বার প্রিমিয়ার লিগে পঞ্চম হয়। ২০০৭-র চ্যাম্পিয়ন এসি মিলান সে বছর সেরি-এ’তে চতুর্থ হয়। বায়ার্ন কিন্তু রেকর্ড ৯১ পয়েন্ট পেয়ে এ বার বুন্দেশলিগা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সামনের শনিবার জার্মান কাপ ফাইনালও খেলবে।
পাঁচ) এত হাড্ডাহাড্ডি ফাইনাল ২০০৮-এ ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড-চেলসি যুদ্ধের পর দেখা যায়নি। গত বার ফাইনালে চেলসির এবং ২০০৯ আর ’১১-র ফাইনালে দু’বারই ম্যান ইউয়ের বিরুদ্ধে বার্সেলোনার আধিপত্য প্রশ্নাতীত।

ফাইনাল-সেরার ট্রফি রবেনের হাতে তুলে দিলেন স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন।
তবে সব মিলিয়ে ওয়েম্বলির ফাইনালের মান খুব উঁচু ছিল বলতে পারছি না। মেসি-রোনাল্ডোর ব্যক্তিগত নৈপুণ্য তো বটেই, জার্মান ফুটবলেরই সেই বিখ্যাত গতি, শুটিং, কাঠিন্য পুরোমাত্রায় কোথায় দেখা গেল? বরুসিয়া যতই সেমিফাইনালের প্রথম লেগে রিয়াল মাদ্রিদকে চার গোল দিয়ে থাকুক, ইউরোপের সেরা টুর্নামেন্টের ফাইনালের মতো বড় মঞ্চে লেওয়ানডস্কি-রয়েসদের যেন কিছুটা অনভিজ্ঞ দেখাল। প্রথম কুড়ি মিনিট বায়ার্ন কিছুটা আড়ষ্ট থাকলেও রবেন-মুলার-রিবেরিদের এ রকম বড় ম্যাচের অভিজ্ঞতাই ওদের দলকে মাঠে প্রতিপক্ষের তুলনায় অনেক তীক্ষ্ম করে তুলেছিল। দু’দলই অনেক সুযোগ নষ্ট করেছে। গোলকিপাররা যত না সেভ করেছে, তার চেয়ে বেশি তাদের গায়ে মেরেছে বিপক্ষ প্লেয়ার।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল এ বার জার্মানির ঘরোয়া লড়াই হল মানে যে, ইউরোপিয়ান ফুটবল এখন জার্মান ক্লাবই শাসন করবে সেটাও মানতে পারছি না। গত বারের চ্যাম্পিয়ন চেলসি তো এ বার গ্রুপ লিগই টপকাতে পারেনি। তা ছাড়া বার্সেলোনায় নেইমার এসে যাচ্ছে। চেলসির দায়িত্ব নিচ্ছেন মোরিনহো। বায়ার্নেই হয়তো হেইনকেস অবসর নিলে গুয়ার্দিওলা কোচ হবেন। অনেক নতুন নতুন ফুটবল-চিন্তন হয়তো পরের মরসুমেই দেখতে পাওয়া যাবে। শুধু জার্মান বোম্বিং নয়!

বায়ার্ন উবাচ
বেকেনবাউয়ার: প্রথমার্ধে যখন রবেন সহজ সুযোগ নষ্ট করল আমার আবার ভয় লেগেছিল। কিন্তু সৌভাগ্য, সেই রবেনের হাত ধরেই এ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগটা পেলাম।
রবেন: খুব হাড্ডাহাড্ডি ফাইনাল হয়েছে। স্বভাবতই শেষ মিনিটে উইনিং গোল করতে পেরে আমি ভীষণ খুশি। অনেকেই কিন্তু আমাকে বলেছিল, তুমি গোল ঠিক পাবেই।
রুমেনিগে: সব সময় ভাল লাগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফিটা বায়ার্নের লকারে দেখতে। গত বছরের ফাইনালে ব্যর্থতার পরে এ বার ফুটবলারদের উপর বিরাট চাপ ছিল। জয়টা শুধু বায়ার্নের নয়, পুরো বুন্দেশলিগার।
হেইনকেস: ফাইনালে ফেভারিট তকমা লেগে যাওয়ায় প্রথমার্ধে ভাল খেলতে পারিনি আমরা। কিন্তু ট্রফি জিততে পেরে আমি প্রচণ্ড খুশি ছেলেদের জন্য। এ বার জার্মান কাপ জিতে ত্রিমুকুট দিতে চাই বায়ার্নকে।
আমার দুই পায়েই টান ধরেছিল। ফাইনালের পর শারীরিক ভাবে আমি শেষ। কিন্তু খুব খুশি আমাদের কোচ হেইনকেসের জন্য। আমরা ভাল খেলিনি। কিন্তু ট্রফি ঘরে তুলতে পারাটাই তো আসল।
ফার্গুসন: অবসর নেওয়ার পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার দেওয়াটাই আমার প্রথম কাজ ছিল।
চ্যাম্পিয়ন্স-কীর্তি
• খেতাব জয়ের ইতিহাসে তিন নম্বরে উঠে এল বায়ার্ন মিউনিখ (৫)। প্রথম দু’টো জায়গায় রিয়াল মাদ্রিদ (৯) ও এসি মিলান (৭)।
• ফাইনালে ওঠার ক্ষেত্রেও তিন নম্বরে বায়ার্ন (১০)। এক ও দু’নম্বরে রিয়াল মাদ্রিদ (১২), এসি মিলান (১১)।
• আগের বার (২০১২) ফাইনালে হেরে পরের বারই (’১৩) খেতাব জয়ের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দল বায়ার্ন। প্রথম দল এসি মিলান। ১৯৯৩-র ফাইনালে হেরে ’৯৪-এ চ্যাম্পিয়ন।
• দুটো ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানোর বিরল তালিকায় চলে এলেন জুপ হেইনকেস (রিয়াল মাদ্রিদ ও বায়ার্ন মিউনিখ)। অন্য তিন জন, আর্নেস্ট হ্যাপেল (ফেয়ানুর্ড ও হামবুর্গ)। অটোমার হিজফিল্ড (বরুসিয়া ডর্টমুন্ড ও বায়ার্ন মিউনিখ)। হোসে মোরিনহো (পোর্তো ও ইন্টার মিলান)।
• আগামী শনিবার স্টুটগার্টের বিরুদ্ধে জার্মান কাপ জিতলে বায়ার্ন মিউনিখ প্রথম ক্লাব হবে যারা জার্মান ত্রিমুকুট জিতবে।

ছবি: রয়টার্স, এএফপি




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.