বিনোদন সিনেমার নতুন বাঁকে
গল্প ছাপিয়ে বিষয়ই নায়ক

কটা ছবি সপ্তম সপ্তাহে পড়ল। অন্যটি দ্বিতীয় সপ্তাহে।
দু’টো ছবিই তার ইউএসপি হিসেবে তুলে ধরেছে দু’টো বিষয়কে। গোলগাল গল্প নয়, তারকার আকর্ষণ নয়, গান নয়। বিষয়। কম আলোচিত, কম চর্চিত বিষয়।
প্রথম ছবিটি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শব্দ’, দ্বিতীয়টি মৈনাক ভৌমিকের ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’।
বলিউড এবং টলিউড, উভয়তই এটাকে একটা নতুন ট্রেন্ড বলেই মনে করছেন সিনেমা-বিশেষজ্ঞরা। এবং তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সিনেমাকে ঘিরেই আজকাল অনেক সময় সামাজিক পরিসরে নিত্যনতুন আলোচনার বিষয় তৈরি হচ্ছে। অনেক ট্যাবু ক্রমশ আলগা হয়ে আসছে। যেমন আমির খানের ‘তারে জমিন পর’ মুক্তি পাওয়ার পরে ডিসলেক্সিয়া নিয়ে আলাপ-আলোচনা, সচেতনতা বেড়েছিল। সুজিত সরকারের ‘ভিকি ডোনর’ স্পার্ম ডোনেশনের মতো বিষয় নিয়ে অনেকটা খোলা হাওয়া আমদানি করতে পেরেছিল। বাংলায় শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায় পরিচালিত ‘ইচ্ছে’ বক্স অফিসে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যার কেন্দ্রে ছিল সন্তানের প্রতি মা-বাবার অত্যধিক অধিকারবোধের মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয়।
জাতীয় পুরস্কারজয়ী ‘শব্দ’ আর ‘গার্লফ্রেন্ডস’ এই মুহূর্তে এই দু’টি ছবি নিয়েও কলেজ ক্যান্টিন থেকে কফি শপ, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট থেকে পাড়ার জটলায় নানা রকম আলোচনা চলছে। বাঙালি আম-দর্শককে একটা নতুন শব্দ উপহার দিয়েছে ‘শব্দ’, যার নাম ‘ফলি আর্টিস্ট’। অন্য দিকে ‘গার্লফ্রেন্ডস’ বাংলায় তৈরি প্রথম চিক ফ্লিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি-র বঙ্গীয় সংস্করণ হিসেবে এটা দেখা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে।
সিনেমা কি তা হলে এখন জনসচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিচ্ছে? সিনেমাকে কেন্দ্র করেই কি নানা বিষয় আতসকাচের তলায় আসছে? সমাজবিদ প্রশান্ত রায়ের মতে, বিষয়টা এতটা একমুখী নয়। “সমাজের মধ্যেই অনেক কথা, অনেক চিন্তার জন্ম হয়। মানুষ চট করে সেগুলো বলে ফেলার সাহস বা সুযোগ পায় না। একটা সিনেমা যখন সেটা দেখিয়ে ফেলে, তখন ওই জমে থাকা, চাপা পড়ে থাকা কথাগুলো হঠাৎ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়।” এটা যে সব সময় সিনেমাকে কেন্দ্র করেই হতে হবে, তার কোনও মানে নেই। প্রশান্তবাবু উদাহরণ দিয়ে বলেন, একটা সময় ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাস বা এখানে সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’র মতো বই কিন্তু এই ভূমিকাটাই পালন করেছিল। তবে এটাও ঠিক, তিনি মেনে নিচ্ছেন, এখন অনেক সময় সিনেমাকেই এই চিন্তার ট্রিগার টিপে দেওয়ার কাজটা করতে দেখা যাচ্ছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, গত কয়েক বছরে তুলনামূলক ভাবে বেশ কিছু অনালোকিত দিক সিনেমায় উঠে এসেছে ঠিকই। কিন্তু সিনেমা থেকে তৈরি হওয়া জনসচেতনতার সীমানাটা এখনও মূলত উচ্চ-মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাঁর কথায়, “উচ্চমধ্যবিত্ত নাগরিক জনতা চিন্তার অনেকটা মুক্তি খুঁজে নিতে চাইছে সিনেমায়। কিন্তু গাঁধীর হরিজন আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ‘অচ্ছুৎ কন্যা’র মতো ছবি যে ধরনের আলোড়ন তৈরি করেছিল, সেই বৃহত্তর রাজনৈতিক যোগাযোগের জায়গাটা এখন আর নেই।” ‘গার্লফ্রেন্ডস’-এর মতো ছবি ওই উচ্চমধ্যবিত্ত দুনিয়াকেই ধরে। আর ‘শব্দ’? “ওটা উচ্চ-মধ্যবিত্তের অনুশোচনা-পর্ব। আহা রে, ওরাও কত কাজ করে ধাঁচের!”
বিষয়-নির্ভর সিনেমার দর্শকরা যে মূলত শহুরে মাল্টিপ্লেক্সের মধ্যেই আবদ্ধ, সেটা অবশ্য পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারছেন না ফিল্ম-করিয়েরাও। তার কারণ, মাল্টিপ্লেক্স এবং ডিজিটাল সিনেমার কল্যাণেই নানা বিষয় নিয়ে ছবি করার সুযোগ বেড়েছে। প্রশান্তবাবুর কথায়, “সাইবার দুনিয়া যে তথ্যবিপ্লবের দরজা খুলে দিয়েছে, তা থেকে একটা নতুন ধরনের স্বাধীনতার বোধ জন্মেছে। সাহস বেড়েছে।” সঞ্জয় মনে করাচ্ছেন, অপেক্ষাকৃত কম বাজেটে নানা ধরনের বিষয় নিয়ে ছবি করার রাস্তা খুলেছে। নতুন বিষয়মুখী সিনেমার ট্রেন্ড তারই ফসল। কৌশিক জোর গলায় দাবি করছেন, এখন বাংলা সিনেমা ‘কনটেন্ট’ বা বিষয়বস্তুকে সেলিব্রেট করার রাস্তায় হাঁটতে পারছে। ‘শব্দ’ ছবিটা যেমন কাহিনি নয়, আদ্যন্তই বিষয়-নির্ভর।
‘ল্যাপটপ’ ছবিটা করতে গিয়েই আইডিয়াটা কৌশিকের মাথায় আসে। অন্ধ মানুষের শ্রবণশক্তি অনেক বেশি প্রখর হয়। “ল্যাপটপের অন্ধ লেখকের ঘরের সাউন্ড ডিজাইনিং করতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক শব্দের ভল্যুম অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। শব্দকে বিষয় করে ছবি করলে কেমন হয়, তখনই ভাবতে শুরু করি।” তারই সঙ্গে মিলে গেল ভারতীয় চলচ্চিত্রের ১০০ বছর। “চলচ্চিত্রে শব্দকে কুর্নিশ করা এবং শব্দ-শিল্পীকে কুর্নিশ করার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত সব টেকনিশিয়ানদের কুর্নিশ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। এবং এটা বলতে পারি, ‘শব্দ’ দেখার পর দর্শক এখন সিনেমায় শব্দ নিয়ে অনেক বেশি সচেতন হতে চাইছেন।
‘গার্লফ্রেন্ডস’ তৈরি করার সময় মৈনাকও একটা বিষয় ধরেই এগিয়েছিলেন কিন্তু। ঠিক করে নিয়েছিলেন, মেয়েদের বন্ধুতা নিয়ে একটা গল্প বলবেন। তারা নিজেদের মধ্যে কী ভাবে আড্ডা মারে, কী ভাবে সুখ-দুঃখের কথা বলে, কী ভাবে হুল্লোড়ে মাতে, সেটা দেখাতে চেয়েছিলেন। “কোনও ভাবেই প্রথাগত অর্থে ফেমিনিস্ট ছবি নয়। আমি ধরতে চেয়েছিলাম মেয়েদের নিজস্ব পৃথিবীকে। সেটা ফেমিনিস্ট নয়, ফেমিনিন।” কিন্তু বারংবার তাঁকে শুনতে হয়েছে, তিনটে মেয়েকে নিয়ে গল্প দর্শক দেখবে না। অধিকাংশ লোকের অবধারিত প্রশ্ন ছিল, “এটা কি ফিমেল ‘দিল চাহতা হ্যায়’?”
কৌশিক এবং মৈনাক দু’জনেই এই মুহূর্তে একটা ব্যাপারে একমত। দর্শক নিত্যনতুন বিষয় চাইছেন, গ্রহণ করছেন। “দর্শক নেবে না জাতীয় ধারণাকে দর্শকরা নিজেরাই অপ্রমাণ করে দিচ্ছেন।” বিষয়মুখী ছবির স্রোত তাই ক্রমশ বাড়বে বলেই টালিগঞ্জের আশা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.