এভারেস্টের পর লোৎসের পথে হাওড়ার ছন্দা
রের মেয়ে ফিরে আসার পর তাকে কী ভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হবে, সেই পরিকল্পনাই করছেন হাওড়ার কোনার বাগপাড়া এলাকার বাসিন্দারা। যে প্রতিবেশীরা পাড়ার উৎসবে মেয়েটাকে নাচানাচি করতে দেখেছেন আর মাঝে মধ্যেই রুকস্যাক কাঁধে করে মাস খানেকের জন্য বেরিয়ে পড়তে দেখেছেন, সেই মেয়েই যে প্রথম অসামরিক মহিলা হিসেবে এভারেস্ট ছুঁয়ে ফেলবে, তা যেন তাঁদের কাছেও স্বপ্ন। শনিবার ভোর ছ’টা দশে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পা রেখে সেই স্বপ্নই সত্যি করলেন বছর ত্রিশের ছন্দা গায়েন।
প্রতিবেশীরা জানালেন, দু’বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর একা হাতে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছিল শান্তশিষ্ট মেয়েটা। রোজ সকালে এক দল ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে ক্যারাটে শেখানো। তার পর সারা দিন দোকানদারি। বিকেলে ফের মাঠে গিয়ে দৌড়ঝাঁপ আর কঠিন কঠিন শারীরিক কসরত। মোটামুটি এই রকমই ছিল ছন্দার রোজের রুটিন। সেই মেয়েটাই হঠাৎ আকাশ ছুঁয়ে ফেলল!
২০০৮ সালে যোগিন ১ এবং ৩ শৃঙ্গে অভিযানে সফল হওয়ার পরেই এভারেস্ট অভিযানের জেদ চেপে বসেছিল ছন্দার মনে। কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়ের পক্ষে এমন অভিযানের স্বপ্ন দেখা যদিও বা সম্ভব, সেই স্বপ্ন সত্যি করার দৌড়টা ততটাই অসম্ভব। কিন্তু কঠিন সেই পথটাকে পার করার মনের জোর, সাহস আর দাঁতে দাঁত চাপা জেদ বোধ হয় প্রকৃত অভিযাত্রীর রক্তেই থাকে। সে পথ যতই বন্ধুর হোক না কেন।

ছন্দা গায়েন। কঠিন লড়াইয়ে সম্বল মনের জোর।—নিজস্ব চিত্র।
২০১১ সালে পারিবারিক অশান্তির কারণে স্বামীর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ছন্দা। এর পরেই হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় কঠিনতর হয়ে ওঠে লড়াই। ভেঙে না পড়ে একা হাতে, নিজের অদম্য চেষ্টায় আস্তে আস্তে বড় করেন বাবার তৈরি করে যাওয়া দোকানটি। ২০১২ সালে সুযোগ আসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুবকল্যাণ দফতর আয়োজিত মনিরাঙ শৃঙ্গ অভিযানে দলনেত্রী হিসেবে অংশগ্রহণ করার। নিজের দায়িত্বে সুষ্ঠু ভাবে সফল করেন সেই অভিযান। এর পরেই ঠিক করে ফেলেন, আর দেরি নয়, উঠে পড়ে লাগতে হবে।
কিন্তু কী ভাবে সম্ভব হল এই অভূতপূর্ব ঘটনা?
এভারেস্ট অভিযানে বেরিয়ে পড়ার আগে মাস ছয়েক ধরে টাকা জোগাড় করার জন্য ছন্দাকে যে পথটা পেরোতে হয়েছিল, তার প্রতিটা পদক্ষেপই যেন এক একটা ‘হিলারি স্টেপ’।
অভিযানের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৭-১৮ লক্ষ টাকা। বিয়ের সময় যে গয়না পেয়েছিলেন তা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন শ্বশুরবাড়ি ছাড়ার সময়ে। মায়ের কিছু গয়নাও ছিল সেগুলি বন্ধক দিয়ে তিন লক্ষ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। এ ছাড়াও সমস্ত বিমা ভেঙে তুলে নেন আরও কিছু টাকা। রাজ্য সরকারের যুব কল্যাণ দফতর দিয়েছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। বাকি টাকাটা ছন্দা আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের থেকে ধার করেছেন। তবে বিনা সুদে।
ধার-দেনা-বন্ধকের এই দীর্ঘ ইতিহাস পেরিয়ে ২৮ মার্চ কলকাতা ছাড়েন। ৮ এপ্রিল সোলো খুম্বুর বেসক্যাম্পে পৌঁছন ছন্দা। তার পর যথা নিয়মে পরবর্তী ক্যাম্পগুলি পেরোতে থাকেন। অভিযান আয়োজক সংস্থা ‘লোবেন এক্সপিডিশন’ সূত্রের খবর, শুক্রবার রাত আটটা নাগাদ সাউথ কলের সামিট ক্যাম্প থেকে শৃঙ্গ জয়ের উদ্দেশে রওনা হন ছন্দা। সঙ্গে ছিলেন একাধিক বার এভারেস্ট ফেরত তাশি শেরপা। আবহাওয়ার গতিক তেমন খারাপ না হওয়ায় বড় কোনও সমস্যায় পড়েননি তাঁরা।
শনিবার ভোরেই সেই স্বপ্নের মুহূর্ত। স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে বেসক্যাম্পে খবর পৌঁছয়, অভিযান সফল হয়েছে। ছন্দার সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে খবর পাওয়া গিয়েছে, এভারেস্ট শিখরে পৌঁছেও সন্তুষ্ট নন ছন্দা। তাঁর পরিকল্পনা আরও এক আট হাজারি শৃঙ্গ লোৎসে ছুঁয়ে আসার। সেই অভিযানটিও সফল হলে আন্তর্জাতিক স্তরের কৃতিত্বের অধিকারী হবেন ছন্দা।
মেয়ের সাফল্যের খবর প্রথম শোনার পরে আবেগে কেঁদে ফেলেন জয়া গায়েন, ছন্দার মা। “বাবার অনুপ্রেরণাতেই পাহাড় চড়ার নেশা পেয়ে বসে মেয়ের। আজ যদি ওর বাবা থাকত...” বলতে বলতেই কান্নায় গলা বুজে এল জয়া দেবীর।
ছন্দার সাফল্যে খুশি সারা বাংলার পর্বতারোহী মহল। হিমালয়ান ক্লাবের সদস্য দেবরাজ দত্ত বললেন, “একার চেষ্টায় ছন্দা যেটা করে দেখাল, বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করছি।”
পর্বত অভিযাত্রী সংঘের সম্পাদক শ্যামল সরকারের কথায়, “ছন্দার এই সাফল্য বাংলার নবীন প্রজন্মের মেয়েদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।” বাংলার প্রথম মহিলা পর্বত অভিযাত্রী দীপালি সিংহের প্রতিক্রিয়া, “১৯৬৭ সালে প্রথম অসামরিক উদ্যোগে মহিলা দল তৈরি করে রন্টি শৃঙ্গ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। সে দিন আমি যে যাত্রাটা শুরু করেছিলাম, আজ তা পূর্ণ হল।”
অবশ্য অন্য মতও আছে। প্রখ্যাত পর্বতারোহী গৌতম দত্ত যেমন বললেন, “প্রকৃত অভিযানের মানসিকতা থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের অভিযাত্রীরা। পর্যটন ব্যবসার (এভারেস্টের কোনও কোনও রুটে যা ঘটে চলেছে) সুযোগ নিয়ে অভিযাত্রী মননকে খাটো করে আরোহণের সংখ্যা বাড়াচ্ছেন। এভারেস্ট তার গুরুত্ব হারাচ্ছে।”

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.