সাহসিনী
বিপক্ষে প্রোটোকল ভেঙে প্রকাশ্য মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত?
মঞ্চে যখন রাষ্ট্রপতি-পত্নী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় গানে বিভোর, তখন দর্শকাসনের প্রথম সারিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের স্ত্রী গুরশরণ কৌর শ্রোতা, রবীন্দ্র আরাধনায় মগ্ন। পাশে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত, কন্যা অহনা-সহ হেমা মালিনী, মিঠুন চক্রবর্তী, শান ...। এমনই হাই ভোল্টেজ, পাওয়ার প্যাক্ড অনুষ্ঠান। প্রোটোকল বহির্ভূত!
“রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে প্রোটোকলের প্রশ্ন ওঠে না। তিনি সবার উপরে,” বক্তব্য শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী, ভারতের ফার্স্ট লেডি। কিন্তু প্রোটোকল মাফিক তো ফার্স্ট লেডি ‘এন্টারটেন করতে পারেন না, এন্টারটেন্ড হতে পারেন।’ সোজা কথায় ফার্স্ট লেডি জনসমক্ষে গান-নাচ-নাটক... যা কিছু বিনোদনমূলক, তাতে অংশ নিতে পারবেন না।
“রবীন্দ্রসঙ্গীত কি নিছক বিনোদন? রবীন্দ্র ভাবাবেগে মিশ্রিত প্রতিটি শব্দে-ছন্দে তো রয়েছে অন্য ব্যঞ্জনা,” শুভ্রার প্রতিক্রিয়া। তাঁর সংযোজন, “কবিগুরুর গানের মধ্য দিয়ে আমি ঈশ্বরের সাধনা করি। তাই তো ফার্স্ট লেডি হওয়া সত্ত্বেও কবিগুরুর জন্মতিথি পালনের সাহস আমি পেয়েছি।”
কথায় কথায় শুভ্রা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “প্রোটোকলে বন্দি হতে চাই না। রবীন্দ্রনাথের গান আমার প্রাণ। রবীন্দ্রজয়ন্তী আমি আগেও পালন করেছি, এখনও করব। প্রতিবছর করব।” আগামী বছর রবীন্দ্রজয়ন্তীতে হিন্দিতে ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্য করার পরিকল্পনা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর ঘরের জানালা দিয়ে কমলা রঙের ফুলে নুয়ে পড়া বিশাল গাছটার দিকে তাকিয়ে জানালেন শুভ্রা।
বরাবরই তাঁর প্যাশন রবীন্দ্রসঙ্গীত। গান ভালবাসেন রাষ্ট্রপতিও। প্রণব মুখোপাধ্যায় সকালে মুঘল গার্ডেন্সে প্রাতঃভ্রমণ করার সময় বাজে নানা ঘরানার সঙ্গীত। দেশাত্মবোধক, ধ্রুপদী... এবং বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাসের গান তিনি শুনতে ভালবাসেন। সেই ১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডের বাড়িতেও রাতে সেবক পদম তাঁর ঘরের প্লেয়ারে চালিয়ে দিতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। রাষ্ট্রপতি ভবনে এসেও যখনই সময় পান গান শোনেন। গভীর রাতে তাঁর ঘরে বা সকালে মুঘল গার্ডেন্সের হাওয়ায় ভাসে, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ, সত্যসুন্দর’ বা ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে।’
এ বছরের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপতি ভবনের অভ্যন্তরের প্রেক্ষাগৃহে হবে রবীন্দ্রসন্ধ্যা।
প্রোটোকল ভাঙার প্রসঙ্গে এ কথাও এসে পড়ে যে ‘খেলা ভাঙার খেলা’ এখন দুনিয়া জুড়ে। শুরু হয়েছে বদলের হাওয়া। যে হাওয়া বইছে বেশ কয়েক দশক ধরে।
মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা শিশুদের স্থূলতা প্রতিরোধ প্রচার ‘লেটস মুভ’ উপলক্ষে প্রকাশ্যে নেচেছেন। টিভি-র অনুষ্ঠানেও তাঁকে দেখা গিয়েছে নৃত্যরতা। চিনের ফার্স্ট লেডি পেং লিউয়ান ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি আর্ট অ্যাকাডেমি’-র ডিন। তিনি এক জন স্বনামধন্য গায়িকাও। এর বেশ কিছু বছর আগে রাজ পরিবারের প্রাতিষ্ঠানিক ঘেরাটোপের বাইরে এসে নিজের স্বাধীনচেতা জীবন বেছে নিয়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন তত্‌কালীন ব্রিটেনের যুবরানি ডায়ানা।
মঞ্চে গুরশরণ কৌর, শীলা দীক্ষিত, হেমা মালিনী, মিঠুন চক্রবর্তী ও শানের সঙ্গে ভারতের ‘ফার্স্ট লেডি’
৮ মে, নয়াদিল্লি। শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের ‘গীতাঞ্জলি’ ট্রুপের শ্রদ্ধার্ঘ্য রবীন্দ্রসন্ধ্যা। ভিভিআইপি’রা তো ছিলেনই, ছিলেন দিল্লির নামীদামি মানুষজন। মুম্বই, কলকাতা থেকে আসা অতিথিরা। এবং অবশ্যই সাধারণ নাগরিক। ঐতিহ্য + সংস্কৃতির সঙ্গে ক্ষমতা ও গ্ল্যামারের মতো মহার্ঘ উপাদানের মিশেলে নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব সঙ্গীতসন্ধ্যা।
‘স্পর্শ নাট্য রং’য়ের উপস্থাপনায় ‘রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী’ শুরুর কথা ছিল সন্ধ্যা সাতটায়। তার দশ মিনিট আগেই ব্যক্তিগত সচিবকে নিয়ে গুরশরণ উপস্থিত। দু’তিন মিনিট বাদেই শীলা দীক্ষিত। প্রেক্ষাগৃহ তখন পূর্ণ হতে শুরু করেছে। ছোট-বড় মাপের নেতা-আমলা থেকে শুভ্রার পুরনো পরিচিতেরা। গীতা ঘোষ, মৃণাল দাশমুন্সি, মন্দিরা চট্টোপাধ্যায়, ভাস্কর ঘোষ, জাগৃতি মিত্র ...। এর পর সকলকে চমকে দিয়ে এসে পড়লেন মিঠুন, হেমা মালিনী, অহনা এবং তারও একটু পরে শান। তবে বলিউডের এই নক্ষত্ররা কিন্তু এখানে শুধুই শ্রোতা-দর্শক।
অনুষ্ঠানের শুরু হল শুভ্রার আঁকা রবীন্দ্রনাথের ছবিকে প্রণাম করে, প্রদীপ জ্বালিয়ে। শুভ্রা, গুরশরণ, শীলা ও এই সমগ্র অনুষ্ঠানের আয়োজক রবীন্দ্রকিশোর সরকার প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন।
ভিভিআইপি অতিথিরা এই আপাদমস্তক বাংলা অনুষ্ঠান কতটা উপভোগ করলেন?
উদ্বোধনী গান ‘নমো নমো...’ ও ‘হে নূতন...’-এর পরে ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে...’ শুরু হতেই হাতে তাল ঠুকতে শুরু করেন গুরশরণ। পাশে বিহ্বল শীলা। ‘আলোকের এই ঝর্নাধারায়’ শুরু হতেই নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না দিল্লির জাঁদরেল মুখ্যমন্ত্রী। তাল ঠুকতে শুরু করলেন। গান কতটা হৃদয়ঙ্গম করলেন গুরশরণ? “টেগোরের গান আমার খুব প্রিয়। বাংলা শব্দ বুঝি না কিন্তু গানের তাল ছন্দ তো বুঝি,” বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী পত্নীর।
হেমাকেও দেখা গেল, কিশোরী সোনালি শর্মার ‘ও জোনাকি, কী সুখে ওই ডানা দু’টি মেলেছ’-র সঙ্গে ‘উল্লাসে প্রাণ ঢেলে’ মাথা নাড়াচ্ছেন। অহনা অবশ্য শান্ত হয়ে বসেছিলেন।
কেন এই বলিউডি তারকারা রবীন্দ্রজয়ন্তীর আসরে? মিঠুন জানালেন, “শ্রদ্ধেয়া বৌদির (শুভ্রা মুখোপাধ্যায়) আমন্ত্রণ।”
তা আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালে তাল মিলিয়ে একটু নাচুন না।
“আরে না না” হেসে ফেললেন মিঠুন। “দক্ষিণ আফ্রিকায় ছবির শ্যুটিং করতে গিয়ে চোট লেগেছিল। তাই আপাতত নো নাচ।”
আর হেমা মালিনী? অনুষ্ঠানের পরে বসন্ত বিহারে গিয়েছিলেন। রাত ১১টা নাগাদ কন্যাকে নিয়ে ফিরলেন হোটেল ‘ললিত’য়ে।
“আরে আসব না? শুভ্রাদিদির অনুষ্ঠান।”
আপনি ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী। রবীন্দ্রগানের সঙ্গে নাচ কেমন লাগল? বাংলা অনুষ্ঠান তো... বুঝলেন কিছু?
“না-বোঝার কিছু নেই। ইংরেজিতে উপস্থাপনা তো ছিল। আর মিঠুন হেল্প করল। গান খুব ভাল লাগল।”
আর নাচ? একটু ভাবলেন হেমা, “এঁরা তো কেউ পেশাদার নৃত্যশিল্পী নন। এমনিতে ঠিকই আছে। রবীন্দ্রনৃত্য আমার নিজেরও খুব ভাল লাগে।”
অনুষ্ঠানের শেষে সমস্ত শিল্পী, কলাকুশলী এবং স্বনামধন্য অতিথিদের স্মারক দিয়ে অভিনন্দন জানানো হল। গুরশরণ, শীলা ও শুভ্রা পালা করে স্মারক তুলে দিলেন সকলের হাতে।
শীলা দীক্ষিত কানে কানে কী বললেন শুভ্রাকে? “অনুষ্ঠান খুব ভাল লাগল... বিশেষ করে ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটি,” পরে হাসতে হাসতে জানান শুভ্রা। এই প্রতিবেদককে শীলা বললেন, “গানের কথা হয়তো সব বুঝলাম না। কিন্তু প্রাণ বড় আরাম পেল, মন বড় আনন্দ পেল।”
শান সংবর্ধনা নিতে মঞ্চে উঠে সকলের অনুরোধে গাইলেন, ‘তোমার খোলা হাওয়া...”
আক্ষরিক অর্থেই তবে কি খোলা হাওয়া! তা না হলে ফার্স্ট লেডি হওয়া সত্ত্বেও শুভ্রা সেই পুরনো দিনের মতো সকলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে অনুষ্ঠান করেন! মহড়ার সময় দেখেছি তিনি প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর অজিত চৌধুরীর সঙ্গে ক্রমাগত আলোচনা করে চলেছেন। গ্রুপের সবচেয়ে খুদে নাচিয়ে অদিতিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে সাহস জোগাচ্ছেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও নিয়মিত মহড়ায় পুরো সময়টা থেকে সকলের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ রাখছেন। এমনকী শিল্পীরা কী করে বাড়ি ফিরবেন তা’ও। এবং মহড়ার ফাঁকে ফাঁকে রীতিমতো সকলের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। দারুণ ঘরোয়া মুডে তিনি। তবে প্রোটোকল?
গান গাইছেন শুভ্রাদেবী
প্রোটোকল নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই তাঁর। এমনকী এ ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ নেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত কারওরই। সকলের উত্‌সাহ শুধু ওই রবীন্দ্রসন্ধ্যাকে ঘিরে। শুভ্রা বারেবারেই বললেন, “১৯৮২ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ ট্রুপ প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে আমি দেশেবিদেশে অনেক অনুষ্ঠান করেছি। যত দিন বেঁচে থাকব রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে যাব। প্রতি বছর অনুষ্ঠানও করব। তবে হ্যাঁ, রবীন্দ্রকিশোর, অজিত এবং মৃণালকান্তি মুখোপাধ্যায় (শুভ্রার সহকারী), এঁরা না থাকলে কিছুই সুষ্ঠু ভাবে করতে পারতাম না। অনুষ্ঠানের কার্ড ছাপানো, লাইট ঠিক করা... আমি কি কখনওই এ সব একা একা পারতাম? সকলকে নিয়েই তো আমার কাজ,” হেসে বললেন রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্ত্রী।
কর্ত্রীর অনুষ্ঠানের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা থাকলেও কর্তা কিন্তু হাজির থাকতে পারেননি। অনেক আগে থেকেই বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে যাওয়া নির্দিষ্ট ছিল তাঁর। নিয়ম ও ঐতিহ্যের অবিসংবাদী সাধক প্রণববাবু সেখানেই গিয়েছিলেন।
এর আগের ফার্স্ট লেডিরা কেউ এ ধরনের অনুষ্ঠান করেননি? যত দূর জানা যায়, তাঁরা সকলেই নানা ধরনের সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কে আর নারায়ণনের স্ত্রী ঊষা, ভবনের প্রান্তরে টিউলিপ লাগিয়েছিলেন। তিনি আবার ছোট গল্পও লিখতেন। তা বই আকারে বেরিয়েছিল।
শুভ্রাও লেখালেখি করতেন। ইন্দিরা গাঁধীকে নিয়ে তাঁর বই ‘চোখের আলোয়’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। বইটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়। এখন অসমিয়া ভাষায় অনুবাদের কাজ চলছে। অন্যটি চিন ভ্রমণ নিয়ে ‘চেনা অচেনা চিন’।
রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায়ও প্রোটোকলে কিছু বদল ঘটিয়েছেন। ‘মহামহিম’য়ের পরিবর্তে সরকারি ক্ষেত্রে তিনি এখন ‘রাষ্ট্রপতিজি’। ‘হিজ এক্সেলেন্সি’ শব্দবন্ধ দেশের কোথাও কোনও অনুষ্ঠানে বা দেশের কোনও ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বাক্যালাপ বা কোনও আদানপ্রদানে ব্যবহার করা হবে না।
তাঁর সহধর্মির্ণী শুভ্রাও তো বদল চান। হয়তো বা সেখানেও জড়িয়ে থাকে রবীন্দ্রচেতনা ‘আমি তোমাদেরই লোক’!

প্রোটোকল
• ফার্স্ট লেডি ‘এন্টারটেন করতে পারেন না। এন্টারটেন্ড হতে পারেন’
• পোশাক বা খাওয়াদাওয়া নিয়ে কোনও বিধিনিষেধ নেই
• দেশে-বিদেশে সফরের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু প্রথা মানতে হয়। সদলবল গেলে সকলকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে সবার শেষে যান রাষ্ট্রপতি। ঠিক তাঁর আগে ফার্স্ট লেডি
• ফার্স্ট লেডি কোথাও গেলে, আগে তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারিকে জানাবেন। সেক্রেটারি জানাবেন এডিসি’কে। এর পর তাঁর যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে
• যে কোনও জায়গায় তাঁর যাওয়ার প্রশ্নে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে

* রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রে যেটুকু জানা গিয়েছে
ছবি: রাষ্ট্রপতি ভবনের সৌজন্যে


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.