ভাগ্যহীন নেতা রাহুল সেই সূতপুত্র থেকে গেলেন
ধোঁয়া! ধোঁয়া! আর ধোঁয়া!
বৃহস্পতিবার ভারতীয় ক্রিকেটমহলের বিবিধ স্নায়ুকেন্দ্রে কথা বলে যা পাওয়া গেল তা হচ্ছে, বিভ্রম, সংশয় এবং অবিশ্বাস। অবিশ্বাস মোটেও শান্তাকুমারন শ্রীসন্ত এবং তাঁর দলবলের কাজকর্ম নিয়ে নয়। ওটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সন্দেহ হল, সত্যি তিন জন? মাত্র তিন জন? আর কেউ নয়? এত বিশাল আইপিএলে যে টিমটা ধারাবাহিক ভাল খেলছে এবং যার ক্যাপ্টেনের নাম রাহুল দ্রাবিড়, কোন ধুরন্ধর বুকি সেই টিমের পিছনেই সর্বস্ব দিয়ে পড়ে থাকবে? কোনও যুক্তিতে আসে? কোনও বুদ্ধিতে আসে?
বরঞ্চ বুকিরা তো সাধারণ ভাবে তাদেরই টার্গেট করবে যারা হারছে। বা মাঝামাঝি রয়েছে। বেছে নেবে এমন সব প্লেয়ারকে যারা মুহূর্তের ডিজাইনে স্পট ফিক্সিং করেও ম্যাচ ফিক্সিং যোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে ম্যাচের ওপর। যে টিমে একাধিক এমন প্লেয়ার রয়েছে যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে এমনকী বোর্ডেরও জানা, এরা হল পঞ্চাশ-পঞ্চাশ ক্যাটেগরি। যতটা স্বচ্ছ, ততটাই অস্বচ্ছ। কয়েক বছর আগে উত্তরাঞ্চলের এক ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক, তাঁর মহাতারকা ক্রিকেটারের মাঠে বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে আইপিএল কর্তার কাছে লিখিত সন্দেহ পাঠিয়েছিলেন। সেই নিয়ে তুলকালাম হয়। খুচরোখাচরা প্লেয়ার অ্যাপ্রোচ করা, সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের দেখা করতে চাওয়া, হোটেলের ঘরে ফোন করা, কেকেআর থেকে শুরু করে সব ফ্র্যাঞ্চাইজিতে ঘটেছে।
বৃহস্পতিবারের বিধ্বস্ত নেতা। ছবি এবিপি আনন্দের সৌজন্যে।
এরা অবশ্যই টার্গেট করেছে ভারতীয় দল থেকে বাদ হয়ে যাওয়া, আয় কমে যাওয়া ক্রিকেটারদের। বা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের আইপিএল বাদ দিয়ে যাদের রোজগার তারকাদের কক্ষপথ থেকে অনেক দূরে।
ক্রিকেটঅলিন্দের গণধারণা হল, এত ধোঁয়া যখন, সেখানে আগুন মাত্র তিনটে জায়গাতেই জ্বলছিল মনে করার কোনও কারণ নেই। বরং আইপিএল-নির্দিষ্ট তদন্ত হলে আরও বার হবে। এতক্ষণে সবারই জানা হয়ে গিয়েছে হ্যান্সি ক্রোনিয়েকে ধরে ফেলাটা যেমন দিল্লি পুলিশের দ্বারা ঘটনাক্রমে ঘটেছিল, এখানেও তাই। দিল্লি পুলিশ অন্য কিছু অনুসন্ধান করছিল, করতে করতে হঠাৎই এই হাওয়ালাচক্রের সন্ধান পায়। আর তার রেশ ধরে গ্রেফতার করে ফেলে সেই ক্রিকেটারটিকে যাঁকে ঘিরে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের আপ্রাণ স্বপ্ন দেখছিলেন।
শ্রীসন্তের প্রগলভ পিতার জানার কথা নয় এ বার শীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় যে কঠিনতম সফরে ভারত যাচ্ছে, তাতে তাদের একমাত্র লাইফলাইন নিজেদের পেস বোলারদের ভাল বল করা। সেই লক্ষ্যে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি-সহ ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট যে পাঁচ জন বোলারকে শর্টলিস্ট করেছিল তাদের মধ্যে শ্রীসন্ত অন্যতম। ভুবনেশ্বর কুমার একজন। বাংলার সামি আহমেদ একজন। আসলে ছ’বছর আগে জোহানেসবার্গে যে টেস্ট সৌরভের কামব্যাক মঞ্চ হিসেবে চিরপ্রসিদ্ধ সেটা ভারতকে জিতিয়েছিলেন শ্রীসন্ত। তিনি ভারতের একমাত্র পেসার যিনি ডেলিভারির সময় সিম একেবারে সোজা রেখে ছাড়েন বলে ধারাবাহিক সুইং থাকে। জাহিরেরও করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু বয়স্ক জাহির ইদানীং এতই আঘাতপ্রবণ যে, ভাবা হচ্ছিল ক্রোনিয়ের দেশে অপেক্ষাকৃত ভাল বাজি হবেন শ্রীসন্ত।
প্রমাণ নেই কেবল সংশয়
১৩ এপ্রিল আরসিবি বনাম সিএসকে
১৩ এপ্রিল মুম্বই ইন্ডিয়ান্স বনাম পুণে ওয়ারিয়সর‌্
পাঁচ ওভারে চেন্নাইকে তুলতে হত ৪৬। এই অবস্থায় করণ শর্মার করা ১৬ নম্বর ওভারে কোনও রান নেননি ডোয়েন ব্র্যাভো। ম্যাচ অবশ্য জেতে চেন্নাই।
মিচেল জনসনের প্রথম ওভারেই পয়েন্টে দাঁড়িয়ে মাইক হাসির পরপর তিন বলে তিনটে ক্যাচ ছাড়েন পোলার্ড। চেন্নাই ৭৯ রানে অল আউট হয়ে ম্যাচ হারে।
কে জানত চল্লিশ লাখের লোভে তিনি রাহুল দ্রাবিড়কে অর্জুন থেকে ফের কর্ণে নামিয়ে আনবেন! রাহুলের অধিনায়কত্ব মানেই যেন কোথাও গিয়ে সেটা জয়ের মধ্যেও বিয়োগান্ত ভাবে শেষ হবে। ২০০৭-এর ইংল্যান্ডে একুশ বছর পর ও দেশে সিরিজ জিতে নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন রাহুল। অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত। কারণটা আজও বলেননি। তবে এ দিন টিভিতে তাঁর লিখিত বিবৃতি পড়ার সময় মুখচোখ দেখে মনে হল, রাজস্থান রয়্যালস অধিনায়কত্বও আজ ছেড়ে দিতে পারলে তাঁর খারাপ লাগত না। পোর্ট অব স্পেনে শ্রীলঙ্কার কাছে যে দিন হেরে প্রাথমিক পর্বেই ভারত বিদায় নিয়েছিল বিশ্বকাপ থেকে সেদিনকার আর আজকের রাহুলকে একই রকম মর্মান্তিক দেখাচ্ছে। তাঁর রাজস্থান রয়্যালস তো শুধু ধারাবাহিক জিতছিলই না, শেন ওয়াটসনের দু’একটা অঙ্গভঙ্গি বাদ দিলে ফেয়ার প্লে পুরস্কারে একেবারে ওপরের দিকে ছিল। দ্রাবিড়ের যা বরাবরের ক্রিকেটীয় আদর্শ চ্যাম্পিয়ন হও এবং তার জন্য জঙ্গি হতে যেও না। আজহার তাঁর প্রথম অধিনায়ক হলেও রাহুল নিজের বিয়েতে নেমন্তন্ন করেননি। অজয় জাডেজা বা নয়ন মোঙ্গিয়ার সঙ্গে সচিন কথা বলেন। রাহুল আজও মাফ করেননি। আর তাঁর টিমেই কি না এমন মহাকলঙ্কের ছায়া। এটা বলাই যায়, ভারতীয় ক্রিকেট এবং বলিউডের যুগ্ম কালো দিন যেখানে এসে দাঁড় করাল, এর পর রাহুলের হাতে ইডেনে আইপিএল ট্রফি উঠলেও সেটা আর অর্জুনের উত্তরণ ঘটাতে পারবে না। অধিনায়ক হিসেবে তিনি সূতপুত্রই থেকে যাবেন অন্যের ওপর বর্ষিত অভিশাপে। নিজের কোনও দোষ না থেকেও।
সকাল থেকে গোটা দিন যে ভাবে গেল প্রাক্তন এক ক্রিকেটার একে ব্যাখ্যা করছিলেন, ‘রামগোপাল ভার্মা দিবস’ হিসেবে। সত্যি যেন তাই। আইপিএলের ওপর কেউ ফিল্ম বানালে সে-ও তো এ রকমই কল্পনা করবে। জাতীয় সব টিভি চ্যানেলে অ্যাঙ্কর নিউজ পড়ছে, দাউদের কালো হাত...সেই ডি গ্যাং... করাচি থেকে দুবাই...আন্ডারওয়ার্ল্ড...তোয়ালেটা উঁচু করে তুললে ষাট লাখ টাকা...বুকি আসছে কোটি টাকা হাতে নিয়ে... হাওয়ালার মাধ্যমে টাকা যাচ্ছে...।
কে জানত রামগোপাল ভার্মা দিবস আর অশুভ ক্রিকেট দিবস যে সত্যিই মিলে যেতে পারে!
ক্রিকেটমহলে অনেকেই বলছিলেন, প্রতি বার ক্রিকেটে গড়াপেটা হলেই যে এমন পৃথিবী তোলপাড় হয়েছে মার্কা রব পড়ে যায়, এটাও বন্ধ হওয়া দরকার। ব্যাপারটা চরম নিন্দনীয় এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও সত্যি সমাজের আর পাঁচটা জায়গায় যদি সত্যের পাশাপাশি অসত্য উঁকি দিতে পারে। যে সমাজে জনপ্রতিনিধিরা উৎকোচ নেওয়ার জন্য নিয়মিত মন্ত্রিত্ব হারান। বিশ্বখ্যাত সাইক্লিস্ট ডোপ করে খেতাব জেতেন। পক্ষের উকিল ও পক্ষের সঙ্গে ষড় করে সওয়ালের তীব্রতা কমিয়ে দেন। সেই পৃথিবীতে ক্রিকেটের সঙ্গে সফেন পবিত্রতাকে এক করে দেখার কোনও মানে হয় না। এই পৃথিবীতে ধরেই নিতে হবে প্রতিটি তেন্ডুলকরের পিছু পিছু একটা শ্রীসন্ত থাকবেন। প্রতিটি সৌরভের আগে একজন আজহার সদৃশ দেখা দেবেন। জাতীয় অধিনায়কত্বও যাঁর কাছে সততার চূড়ান্ত চৌম্বকক্ষেত্র হবে না। এঁরা মনে করেন, ডব্লিউ জি গ্রেসের সেই তথাকথিত সন্ত ভিক্টোরিয়ান সমাজেও যদি ক্রিকেটমাঠ ঘিরে ফন্দিফিকিরের প্রকোপ থাকতে পারে, আধুনিক আমলেও নিয়মিত তা মাথাচাড়া দিচ্ছে বিচিত্র কী!
কাশ্মীর থেকে শ্রীসন্তের শহর কোচি। কলঙ্কিত প্রভাকর থেকে বিতর্কিত কাম্বলি। কারও অবশ্য একটা কথা মেনে নিতে সমস্যা নেই যে, আইনরক্ষকরা অপরাধদমনে মোটেও স্মার্টনেস দেখাননি। একটা টি টোয়েন্টি ম্যাচকে সাবেকি পাঁচ দিনের ক্রিকেটের ঢঙে খেলতে গেলে যা হয়, শ্রীনিবাসনরা সে ভাবেই খেলে মুখে চুনকালি মেখেছেন। এ দিন লক্ষ্মীরতন শুক্ল বলছিলেন, “টুর্নামেন্ট শুরুর দু’দিন আগে একটা ভিডিও দেখায়। তাতে সব বলে কী ভাবে বুকিরা অ্যাপ্রোচ করতে পারে। কী ভাবে চলতে হবে, এই সব। এরপর আর গোটা টুর্নামেন্টে দু’মাস কোনও ক্লাসটাস হয় না।” কোনও কোনও ভারতীয় ক্রিকেটারের মনে হচ্ছে, স্মার্ট আইনরক্ষা যদি বোর্ডের পক্ষে অসম্ভব হয়, তারা অন্তত বলতেই তো পারে আমার অধীনে চুক্তিবদ্ধ সমস্ত ক্রিকেটার এবং তোমরা যারা আইপিএল খেলছ, সাপোর্ট স্টাফ সমেত সবাইকে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি, আয়ের হিসেব বোর্ডকে দিতে হবে। এর পর সেটা অনুসন্ধান করে দেখবে বোর্ড নিযুক্ত কোনও সংস্থা। আয়-ব্যয়ে বিশাল কোনও অসঙ্গতি আছে কি না?
সনাতন ক্রিকেটবৃত্তের বাইরে থাকা অথচ আইপিএল সাম্রাজ্যের সম্ভ্রান্ত নাগরিক প্রীতি জিন্টা এ দিন প্রস্তাব তুলেছেন, যেমন র্যান্ডম ডোপ পরীক্ষা হয়। তেমনই র্যান্ডম লাই ডিটেক্টর টেস্ট হোক আইপিএলে। শুনে স্টিভ ওয়-র কথা মনে পড়ে গেল। যিনি বছর দু’য়েক আগেই একই প্রস্তাব তুলেছিলেন। তফাতের মধ্যে লর্ডসে দাঁড়িয়ে এমসিসি-কে বলেছিলেন, প্রত্যেকে নিয়মিত ভাবে লাই ডিটেক্টর টেস্ট হোক। সে দিন স্টিভের প্রস্তাব ‘বড় বেশি চরমপন্থী’ যুক্তিতে খারিজ হয়ে যায়।
গণহতাশা তৈরি হচ্ছে এটা ভেবে যে, গোটা টুর্নামেন্টে সম্পূর্ণ অকিঞ্চিৎকর অবস্থান সম্পন্ন তিন বিপথগামী ক্রীড়াবিদ আইপিএল গ্রহণ করে দিল। এদের মিলিত পারফরম্যান্স মাত্র ১২ উইকেট। কেউ একটাও ম্যাচ জিতিয়েছে বলে অভিযোগ নেই। অথচ এরা ঢেকে দিল কিনা ক্রিস গেইলের রাজসিক সব ছক্কা। মহেন্দ্র ধোনির আপাত অবিস্মরণীয় সব ম্যাচ ফিনিশিং। ডেল স্টেইনের দুর্দান্ত ফাস্ট বোলিং। সুনীল নারিনের জাদুগরি। গিলক্রিস্টের দ্বাদশ ম্যাচে গিয়ে প্রথম রান পাওয়া। রিকি পন্টিংয়ের ক্রমাগত ব্যর্থতা-বিদ্ধ হয়ে টিম থেকেই নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। দ্রাবিড়ের সেই সাবেকি নৈপুণ্য। তেন্ডুলকরের প্রচণ্ড লড়াই করেও কিছুতেই ৫৫ রান পৌঁছতে না পারা!
এ সবই ক্রিকেট সততার অপাপবিদ্ধ দৌড়। যেখানে কখনও ক্রীড়াবিদ দৌড় জিতবে। কখনও পাথরে আছড়ে পড়বে। কখনও জলে ডুববে। কখনও বিস্ফোরণের শিকার হবে। কিন্তু কখনও যাত্রাপথে পৌঁছতে অন্যায় সাহায্য নেবে না।
১৬-ই মে ২০১৩-র পর অন্তত আইপিএলে যে ন্যায়ের পথে থেকেও জেতা যায়, কোটি কোটি গ্রাহককে বোঝানো সমস্যা হবে। কোনও এক তেন্ডুলকরে সম্পূর্ণ আস্থা রেখেও তারা বলবে, রান করেছে ভাল কিন্তু ওকে যে বল করছিল সে নির্ঘাত টাকা খেয়েছে! দেখিসনি ড্রিঙ্কস ব্রেকে তোয়ালেটা তুলেছিল!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.