আনন্দবাজার এক্সক্লুসিভ
এই বিচারের ঝাপটাটা
শ্রীনিবাসনদের প্রাপ্য ছিল
ক্রিকেট সাংবাদিকদের ভাবনায়, আমাদের মতো দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ‘পশ্চিমী দেশ’ অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল। শুধু ইংল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকা তার মধ্যে পড়লে তা-ও বা একটা কথা ছিল। অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড নিশ্চয়ই পশ্চিমী নয়। তবু আমাদের মতো এই তথাকথিত পশ্চিমী দেশগুলোতে ভারতীয় বোর্ডের ভাবমূর্তি ক্রমশই ফিকে হচ্ছিল। আজকের ঘটনাটায় সেটা একেবারেই বিবর্ণ হয়ে গেল। আইপিএলের জৌলুসটা তো কমলই, তার সঙ্গে ভারতীয় বোর্ডের ভিতরকার অন্ধকার চেহারাটা আবার সামনে এল। একেই হয়তো বলে পোয়েটিক জাস্টিস।
ভারতীয় বোর্ডের দাদাগিরি আমরা বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখছি। জগমোহন ডালমিয়া যখন আইসিসি-র প্রেসিডেন্ট, দাদাগিরির তখনই শুরু। আজ শ্রীনিবাসনের আমলে সেটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখানে আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে, মিস্টার ডালমিয়ার আমলে যেটা লুকিয়ে-চুরিয়ে তবু একটা শরম রেখে হত। অধুনা সেটা এখন চূড়ান্ত লাজ-লজ্জাহীন ভাবে হচ্ছে। ভারত কাউকে কোনও কেয়ারই করছে না। কে কী ভাবল, তাতে পাত্তা দিচ্ছে না। অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে ঘিরে মাঙ্কিগেট যখন প্রথম ঘটল তখনই ভারতীয় বোর্ডের পেশিশক্তির নমুনা বাকি বিশ্ব প্রথম পায়। ভাবলে আজও স্তম্ভিত লাগে কী ভাবে ভারতীয় বোর্ড স্রেফ দাদাগিরি করে পুরো ব্যাপারটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
উত্তাল ভারত
বেঙ্গালুরু
আইপিএলটাও যে ভাবে ওরা করে সম্পূর্ণ দাদাগিরি। ওই দু’টো মাস আইসিসি প্রোগ্রাম অ্যান্ড ফিক্সচার্স কমিটি ঠিক না করলেও বকলমে ধরে নেওয়া হয় এপ্রিল-মে-তে বিশ্বে আর কেউ কোথাও ক্রিকেট খেলবে না। সর্বত্র যেখানে যে সব সেরা প্লেয়ার আছে, সবাই শুধু আইপিএল খেলবে। এত টাকা আইপিএল খেললে পাওয়া যায় যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দেশের ক্রিকেটাররা নিজের দেশ ভুলে গিয়ে আইপিএল খেলে। আমার তো মনে হয় এর জন্য বিসিসিআইয়ের বিভিন্ন দেশের বোর্ডকে মোটা টাকা ভর্তুকি দেওয়া উচিত। কারণ তারা ক্ষতি স্বীকার করে আইপিএলটা হতে দিচ্ছে। অথচ বিসিসিআই এক ডলারও দেয় না।
আমাদের এখানে বসে বরাবরই মনে হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বিশ্বকে যেমন একটা তেন্ডুলকর দিয়েছে। যাঁকে নিয়ে আমরাও বরাবর উচ্ছ্বসিত। যেমন একটা দ্রাবিড় দিয়েছে যাঁর স্পোর্টসম্যান স্পিরিট আর মূল্যবোধ আমাদেরও মুগ্ধ করে। গাঙ্গুলি যাঁর তেজি মনোভাব অস্ট্রেলিয়ানরাও সম্মান করে। তেমনই প্রচুর দুর্নীতিরও জন্ম দিয়েছে। এই ক’দিন আগেই যখন টিম মে বনাম শিবরামকৃষ্ণন নিয়ে বিসিসিআই একটা নোংরা জট পাকাল, তখন তীব্র সমালোচনা করেছিলাম ওদের। লিখেছিলাম, বিশ্বে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্ডেক্সে ভারতের স্থান ৯৪ নম্বরে। আর তার একটা বড় দুর্নীতির জায়গা হল ক্রিকেট বোর্ড। যে ভাবে ভারতীয় বোর্ড সর্বজনশ্রদ্ধেয় টিম মে-কে রোখার জন্য সমস্ত নীতিশাস্ত্র ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল, অন্যায় ভাবে যে রকম ভোটে হারিয়েছিল, তাকে দুর্নীতি ছাড়া কিছুই বলা যায় না। কালকে অমন নির্বিরোধী মাইকেল ক্লার্ক অবধি প্রেস কনফারেন্সে এসে বলল, আমি টিম মে-র বিশাল বড় সমর্থক। ক্রিকেট কমিটিতে ওর সমর্থনে ভোটও দিয়েছিলাম। সেই মে-কে যে ভাবে ভারত রুখেছে। ভোটে হারিয়েছে। তারপরেই আইপিএল কেলেঙ্কারি ওদের মুখে ডিমের খোসা পড়ার মতো।
একবারও বলছি না ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ভুল করে না। প্রচুর ভুল করে। শেন ওয়ার্ন আর মার্ক ওয়কে সাসপেন্ড না করে ওরা যে ভাবে ছেড়ে দিয়েছিল সেটা ক্ষমার অযোগ্য। তখন আমি লিখেছিলাম, বুকিদের সঙ্গে সামান্যতম যোগাযোগের জন্য দু’জনের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এই পরিমাণ দুর্নীতিগ্রস্ত কাজকর্ম করে না। আমি তো সিডনিতে বসে সে দিনই খবরে দেখলাম, বিসিসিআই প্রেসিডেন্টের বিভিন্ন কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্ত করছে। যার নিজের দেশের তদন্তকারী সংস্থাই তার সম্পর্কে বিশ্বাস রাখবে কি না ঠিক করতে পারছে না, সেখানে অন্যদের দোষ কী?
উত্তাল ভারত
আমদাবাদ
বোঝাই যাচ্ছে ভারতীয় বোর্ড আইপিএলে স্পট ফিক্সিং আটকানোর জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি। সমস্যা হয় কী, ভারতীয় বোর্ডের এই সব অকর্মণ্যতার জন্য গোটা খেলাটার গায়ে কাদা লেগে গেল। সিএনএন-এর মতো আন্তর্জাতিক চ্যানেল যারা ক্রিকেট নিয়ে আদৌ খবরাখবর করে না, তারাও গত বছর ভারতীয় বোর্ডের আইপিএল কেলেঙ্কারি নিয়ে লম্বা শো করছিল। দেখাচ্ছিল, কী ভাবে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে আইপিএল বিতর্কে জড়িয়ে ইস্তফা দিতে হয়েছে। সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল যদি এই খেলাটা নিয়ে কেবল অন্ধকার দিকেরই খোঁজ পায়, তাতে কি ভাবমূর্তির কোনও সুবিধে হয়?
আইপিএল থেকে ফিরে আসা অস্ট্রেলিয়ানদের মুখে টুর্নামেন্ট সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি। কোনও মতেই পুরো শো-টা স্টেজ ম্যানেজ নয়। লড়াই, স্কিল এবং সাহসের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয় আইপিএল। মোটেও সেই সব চ্যারিটি ম্যাচের মতো হয় না, যেগুলো সম্পর্কে অবিশ্বাস্য সব কাহিনি শুনেছি। কিন্তু স্কিল যুদ্ধের পাশাপাশি আইপিএলে বরাবরই এমন সব ঘটনা ঘটেছে যেগুলো সন্দেহজনক। এক অস্ট্রেলীয় কোচ আমাকে বলেছিলেন, ওঁর দু’জন বোলার শুরুর দিকে ভাল বল করতে করতে হঠাৎ করে পরের দিকে দু’জনেই ঝোলাতে শুরু করে। কোচের ব্যাপারটা ভীষণ আশ্চর্য লেগেছিল। আর এক কোচ আমাকে বলেছিলেন, সব ব্যাটিং অর্ডার ঠিকঠাক। হঠাৎ করে এক সিনিয়র প্লেয়ার এসে তাঁকে কিছু না বলেটলে ব্যাটিং অর্ডার বদলে দেয়। এটাও ঘটে নাকি একাধিক ম্যাচে। কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু তিনি মহাশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। আর এক ওপেনিং ব্যাটসম্যান আমাকে বলেছিল, তার বিপক্ষে করা প্রবাদপ্রতিম ফাস্ট বোলারের কথা। যে প্রথম দু’টো বল বিস্ময়কর ওয়াইড করেছিল। তার পরের বলটাই অফস্টাম্প উড়িয়ে দেয়। ওপেনারের আউট হয়েও বিস্ময়কর লেগেছিল যে কী করে প্রথম দু’টো বল অত বড় ওয়াইড হতে পারে? আবার বলছি এগুলোর কোনওটারই প্রমাণ নেই। কিন্তু সন্দেহ ছিলই। বৃহস্পতিবারের পর সেগুলো জমি থেকে আকাশ সর্বত্র ভেসে উঠল। কোথায় লুকোবে ভারতীয় বোর্ড? এ বার তো উত্তর দিতেই হবে। অবশ্যই নব্বই শতাংশ ক্রিকেটার এর মধ্যে জড়িত নয়। হয়তো বা আরও বেশি শতাংশ নয়। কিন্তু ভারতীয় বোর্ডকে বলতে হবে জড়িত এই সামান্য ক’টা বাজে আপেল, তাদের ধরতে পারেনি কেন?
আইসিসি-র ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। তাদের যে অ্যান্টি করাপশন সেট আপ সেটা কি তা হলে বেকার? আইসিসি অবশ্য উল্টে বলতে পারে লর্ড কন্ডনের রিপোর্টে সেই কবেই বলা ছিল ভারত হচ্ছে জুয়াড়ি আর স্পট ফিক্সিংয়ের পীঠস্থান। ছ’-সাত বছর আগে সেই রিপোর্ট দিয়ে দেওয়া হয়। তা হলে ভারতীয় বোর্ড এত দিন ঘুমিয়ে ছিল কেন?
আর আমি টিম মে হলে বলতাম, আমাকে ভোটে হারিয়ে দেওয়া হল ঠিক আছে। কিন্তু আজ বোধহয় সবাই বুঝছে ক্রিকেট কী পরিমাণ বিপন্নতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। দেখছে, যারা খেলাটা চালায় তারাই কী রকম একটা নোংরা সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। আমি টিম মে হলে বলতাম, আজ নিশ্চয়ই বুঝলেন একটা পরিবর্তনের দরকার ছিল।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.