ডাক্তার সেজে ঠকাচ্ছেন, ভালই জানেন শ্যামলাল
চেম্বারে বসে রয়েছেন শ্যামলাল যাদব। পরপর রোগীরা আসছেন। কখনও প্রসূতি, কখনও সদ্যোজাত শিশু। আবার কখনও বা মুমূর্ষু স্নায়ুরোগী। ‘অল রাউন্ডার’ শ্যামলাল খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখছেন। প্রেশার মাপছেন। ইসিজি, রক্ত পরীক্ষা করাতে বলছেন। গম্ভীর মুখে ফি নিয়ে পরের রোগীকে ডাকছেন। চেম্বারে রোগী তো বটেই, এমনকী মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদেরও ভিড়!
যে কোনও চিকিত্‌সকের মতো শ্যামলালের প্রেসক্রিপশনেও একটি রেজিস্ট্রেশন নম্বর রয়েছে। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশনের সঙ্গে যার কোনও যোগ নেই। তা হলে এটা কীসের রেজিস্ট্রেশন? দৃপ্ত কন্ঠে শ্যামলালের জবাব, “ক্যানাল স্ট্রিটের মেডিক্যাল কলেজের।” ক্যানাল স্ট্রিটে আবার কোন মেডিক্যাল কলেজ? আর কোনও মেডিক্যাল কলেজ রেজিস্ট্রেশনই বা দেবে কী ভাবে? তিনি বলেন, “দেয়, আপনি জানেন না।”
শ্যামলাল নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি স্কুলের গণ্ডি পেরোননি।
চেম্বারে বসে প্রেসক্রিপশন লিখছেন ‘ডাক্তার’ শ্যামলাল যাদব। বুধবার। ছবি: সুদীপ আচার্য
এলাকায় অনেকেই জানেন, তিনি ছিলেন অনিলকুমার দত্ত নামে স্থানীয় এক স্ত্রীরোগ চিকিত্‌সকের গাড়ির চালক কাম কম্পাউন্ডার। ওই চিকিত্‌সক স্নায়ুরোগে শয্যাশায়ী হওয়ার পরে গত কয়েক বছর তিনিই ‘ডাক্তার শ্যামলাল যাদব’ হয়ে ওই চেম্বার সামলাচ্ছেন। প্রত্যন্ত গ্রাম নয়। খাস কলকাতা শহরের এন্টালি সি আই টি রোডের মতো ব্যস্ত এলাকায় এ ভাবেই রোগী দেখা চলছে বছরের পর বছর।
এ ভাবে ডাক্তারি করা যে ‘ঘোরতর বেআইনি’, তা জানিয়েছেন রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার দিলীপকুমার ঘোষও। কিন্তু আইনের ফাঁক রেখে তাঁর বক্তব্য, পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগ না জানালে এ ক্ষেত্রে পুলিশ কিছু করতে পারবে না। আর কাউন্সিলের নিজের পক্ষেও উদ্যোগী হয়ে কিছু করার নিয়ম নেই।
একই কথা বলছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও। তাঁর বক্তব্য, “এটা আমাদের এক্তিয়ারে নেই। লোককে ঠকানো হচ্ছে। যাঁরা ঠকছেন, তাঁরা পুলিশকে অভিযোগ করলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।” যার অর্থ, পুলিশে আনুষ্ঠানিক ভাবে অভিযোগ না জানানো পর্যন্ত এই ভূয়ো চিকিত্‌সকের ‘ব্যবসা’ চলতেই থাকবে।
কীসের ভিত্তিতে তিনি এ ভাবে রোগী দেখছেন? বুধবার শ্যামলালের চেম্বারে বসে এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “ডক্টর অনিল দত্তর কাছে কাজ করার সময়ে সব শিখে নিতাম। এখন আমি রোগী দেখি, রক্ত নিই, ড্রেসিং করি। কোনও কাজে এতটুকু খুঁত নেই। ডাক্তারবাবুর পুরনো রোগীরাও অনেকে আমার কাছে আসেন।”
কথা চলাকালীনই চেম্বারে ঢুকলেন এক তরুণী। কোলে কয়েক মাস বয়সের একটি শিশু। স্টেথো দিয়ে তাকে পরীক্ষা করে শ্যামলাল বললেন, “ইঞ্জেকশন দিতে হবে।” যেমন কথা, তেমন কাজ। ড্রয়ার থেকে সিরিঞ্জ বার করে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন। কীসের ইঞ্জেকশন? শ্যামলাল জানালেন, “ওটা একটা ভ্যাকসিন।” যে সিরিঞ্জ দিয়ে ইঞ্জেকশন দিলেন, সেটা নতুন নয়। ওই একই সিরিঞ্জ কত জনের শরীরে প্রবেশ করেছে, তার বোধহয় কোনও হিসেবই নেই।
রোজ কত রোগী আসেন শ্যামলালের কাছে? শ্যামলাল বললেন, “গুনি না।” ১০-১২ জন? মুচকি হেসে শ্যামলাল বলেন, “এর দ্বিগুণ হয়।” ফি কত? “গরিবদের কাছ থেকে ৭০-৮০ টাকা নিই। বড়লোকদের কাছ থেকে বেশি।”
এ ভাবে প্রথাগত কোনও শিক্ষা ছাড়া যথেচ্ছ চিকিত্‌সা করা যে অপরাধ, তা কি তিনি জানেন? ধরা পড়ে গিয়েছেন, তা বুঝতে পেরে শ্যামলালের সাফাই, তাঁর কাছে অল্টারনেটিভ মেডিসিন-এর একটি প্রতিষ্ঠানের শংসাপত্র রয়েছে এবং তিনি এক জন ‘রুরাল মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার’। কলকাতা কবে থেকে গ্রাম হল? শ্যামলাল নিরুত্তর।
কেন এমন এক জনকে চেম্বার চালানোর অনুমতি দিলেন তাঁরা? চিকিত্‌সক অনিল দত্তের বাড়িতে যোগাযোগ করা হলে ‘মিসেস দত্ত’ পরিচয় দিয়ে এক মহিলা বলেন, “শ্যামলালের কাছে চিকিত্‌সা করিয়ে কেউ কি মারা গিয়েছে? তা হলে এ নিয়ে এত মাথা ব্যথা কেন?” কিন্তু ডাক্তার না হয়েও ডাক্তার সেজে চেম্বার চালানোর অর্থ তো লোককে ঠকানো? ওই মহিলা বলেন, “শ্যামলাল বিহার থেকে ডাক্তারি পাশ করেছে।” কিন্তু উনি নিজেই তো স্বীকার করেছেন যে উনি স্কুলের গণ্ডি পেরোননি? কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তিনি বলেন, “এত দিন পরে এ সব কথা ওঠার কোনও মানে নেই। ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া ছাড়া শ্যামলাল সব করতে পারে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.