হিজিবিজিও যখন নিমেষে ছবি
সাদা বোর্ডটার উপর খানিক হিজিবিজি কেটে দিয়েছেন কেউ। দ্রুত হাতের কয়েকটা আঁচড়ে সেটাই নিমেষে হয়ে উঠল ড্রাগন। কিংবা বোর্ডে লেখা ‘ক, খ’ মিনিট খানেকের মধ্যেই ব্যস্ত রাস্তায় ছুটন্ত গাড়ি। এমনই ক্ষমতা ছেলেটার।
বছর সতেরোর সৌরদীপ চক্রবর্তী ওরফে রেমো জন্ম থেকেই ১০০ শতাংশ শ্রবণশক্তিহীন (প্রোফাউন্ড হিয়ারিং লস)। হিয়ারিং এড পরে, ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে যেটুকু কথা বোঝে। শহরের একটি এনজিও-র সাহায্যে স্পিচ থেরাপি, ল্যাঙ্গোয়েজ ডেভেলপমেন্ট-এর কোর্স করে এখন অস্পষ্ট উচ্চারণে ভেঙে ভেঙে কথা বলতে পারে মাত্র। অথচ যে যা খুশি দাগ দিয়ে দিক, অক্ষর লিখুক কিংবা স্রেফ হিজিবিজি কাটুক তা থেকেই নিমেষে একটা ছবি এঁকে ফেলতে পারে রেমো।
ছবি আঁকায় ব্যস্ত রেমো।
অনেকটা পি সি সরকারের চেনা ম্যাজিকটার মতোই। তাঁকেই তো গুরু মানে ছেলেটা। রাজপুরের বাড়িতে ক্লাস থ্রি-র রেমোকে পড়াতে পড়াতে এক দিন খাতার এক কোণে হিজিবিজি দাগ কেটেছিলেন মা অনিন্দিতা চক্রবর্তী। তার পরেই অবাক হয়ে দেখেন নিমেষে তার থেকেই আস্ত একটা ছবি এঁকে ফেলেছে ছেলে। তার পরে পরীক্ষা করতে পরপর নানা রকম রেখা আঁকেন খাতায়।
কখনও সোজা, কখনও বেঁকা, কখনও বৃত্ত, ত্রিভুজ বা তারা। প্রতিবারই তার থেকে একটা একটা করে ছবি এঁকে ফেলতে থাকে রেমো। সেই শুরু। তার পর থেকেই যে যখন যে দাগই দিক, তার থেকে ছবি এঁকে ফেলে সে। ছবি আঁকার শুরুটা অবশ্য আরও আগে। বছর তিনেক বয়স থেকেই টিভিতে দেখা কার্টুন আঁকত রেমো। বছর পাঁচেক বয়সে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের প্লেন আছড়ে পড়ার দৃশ্যটাও অবিকল এঁকে ফেলে বোর্ডে। তার পর থেকেই দেদার ছবি আঁকা, প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই। মায়ের কাকা অরুণ মিত্রকে দেখিয়ে নেওয়া কখনও সখনও। ব্যস।
মাঝে চার-পাঁচ বছর কান সংক্রান্ত এক রোগে শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে শয্যাশায়ী ছিল রেমো। মনের জোরে সেখান থেকে উঠে এসে এখন রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যলয় থেকে মাধ্যমিক দিচ্ছে। আর্ট কলেজে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে এক বছর হল শুরু করেছে আঁকা শেখা। তার শিক্ষক রৌদ্র মিত্র বলেন, “আমি তো ওকে বড়জোর জলরং বা পেন্সিল ড্রয়িং শেখাই। এই যে কোনও কিছু থেকে ছবি এঁকে ফেলার ক্ষমতাটা একেবারে ওর নিজের। আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম প্রথম দিন।”
ড্রাগনের ছবি।
কানে শুনতে পায় না রেমো। তাতেই কি বেড়ে গেল ওর দেখার ক্ষমতা?
অডিওলজিস্ট কৃত্তিকা আয়েঙ্গার সাহা বলছেন, “ওর এই ছবি আঁকার ক্ষমতাটার সঙ্গে কানে শুনতে না পাওয়ার এমনিতে কোনও সম্পর্ক নেই। তবে ওর জগৎটা তো পুরোপুরি দৃশ্যনির্ভর। সেটাই ওর ছবি আঁকার বা কল্পনা করার
ক্ষমতাটা বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু কানে শুনতে না পেয়ে যেহেতু কথাও ঠিকমতো বলে উঠতে পারে না, তাই এটা ও কী করে শিখল, সেটা বোঝাতেও পারে না সে ভাবে।”
কানে শুনতে না পাওয়াটাই যে রেমোর দেখার ক্ষমতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, তা বলছেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালও। তাঁর কথায়, “কারও যখন একটা ইন্দ্রিয় কমজোরি হয়, অন্য একটা ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা বেড়ে যায়। একে বলে ‘কমপেনসেটেড সেনসরি প্রসেস’। তাই ও একটা দাগ দেখেই ছবিটাও দেখতে পায়। একই সঙ্গে ওর মধ্যে সৃজনশীলতা রয়েছে, বুদ্ধিও। তাই বোধের চেতনায়, অনুভবের গভীরতায় দর্শনেন্দ্রিয় প্রখর হয়েছে। একটা দাগ কাটলেই ও তার থেকে একটা ছবি কল্পনা করে ফেলতে পারছে সঙ্গে সঙ্গে। এটা নিঃসন্দেহে একটা বিশেষ প্রতিভা।”
রেমোর ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন চিত্রশিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, “আমি ছেলেটির আঁকা দেখিনি। তবে এটা একটা বিশেষ প্রতিভা। সবাই এমনটা পারে না। ওর একটা দিক বন্ধ বলে, আর এক দিকে ওর বিকাশ ঘটেছে। আসলে ছবি আঁকাটা তো একটা মুক্তির পথ। তাই ছবির ভাষাতেই নিজেকে মেলে ধরছে ও। এটা ওর নিজের অক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াইও বটে।” সেই লড়াইটাই তো করে চলেছে রেমো। নামী শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখা ছেলেটা তাই একটা আঁচড় দেখেই কল্পনার জাল বোনে। সেটাই হয়ে ওঠে ছবি। নিমেষে।

—নিজস্ব চিত্র
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.