পা কাঁপছে, প্রাণপণে ডাল নাড়াচ্ছিলেন ওঁরা
দু’হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছিল মৃত্যু! তার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন চার যুবক। কাকভোরের শহরে সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামনে তাঁরাই তুলে দিলেন প্রাচীর।
উল্টোডাঙার উড়ালপুলের উপর দিয়ে ওয়াগন-আর চালিয়ে দিব্যি আসছিলেন ওঁরা চার জন। পালান ঘড়ুই, অসিত দাস, সজল চট্টোপাধ্যায়, অমিত সরকার। স্টিয়ারিংয়ে অসিত। গাড়ির কাচ তোলা। হাল্কা হিন্দি গানের কলি বাজছিল স্টিরিওতে। রবিবারের ভোর বেশ ভালই উপভোগ করছিলেন ওঁরা। হঠাৎই জোরে ব্রেক কষলেন অসিত। সামনের দিকে তাকিয়ে খালি হয়ে গেল বুকের খাঁচা উড়ালপুলের মাথায় সামনে আর রাস্তা নেই! তার বদলে প্রায় পঞ্চাশ ফুট নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নোংরা জলের মধ্যে প্রবল তোলপাড় চলছে। একটু এগিয়ে গিয়ে নীচে উঁকি দিয়ে দেখেন, উড়ালপুলের অংশটি কাত হয়ে পড়ে রয়েছে জলের উপরে। একটি লরি খেলনার মতো ঝুলছে ভেঙে যাওয়া উড়ালপুলের গা থেকে।
স্টিয়ারিং-এ বসা অসিত যদি ঠিক সময়ে বুঝতে না পারতেন, তা হলে তো উড়ালপুল থেকে সোজা খালেই পড়ার কথা ছিল তাঁদের!
এই চার জনের জন্যই এড়ানো গিয়েছে আরও বড় দুর্ঘটনা। —নিজস্ব চিত্র
মৃত্যু ছাড়া আর কী! অসিতের পাশে দাঁড়িয়ে বাকি তিন বন্ধু তখন খামচে ধরেছেন তাঁর জামার হাতা।
পুরনো ওয়াগন-আর গাড়িটা সদ্য কিনেছেন পালান। পালান ঘড়ুই, বছর ৩৫ বয়স। বাড়ি দত্তাবাদে। তারাপীঠ থেকে গাড়ির জন্যই পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন পাঁচ বন্ধু। রাত পৌনে চারটে নাগাদ বন্ধু সুকুমারকে নামিয়ে দিয়েছিলেন বিরাটিতে। তার পর ভিআইপি রোড ধরেন বাকি চার জন। সেতু ভেঙে পড়েছে দেখে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে তাঁরা গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টোডাঙা মোড় হয়ে চলে যেতে পারতেন। যে শহর বারবার তার অমানবিক মুখকে সামনে এনেছে, রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ মানুষের দিকে ফিরে তাকায়নি, সেই শহরে পালান-অসিত-সজল-অমিতরা নতুন গল্পের জন্ম দিলেন।
রবিবার সন্ধ্যায় চার বন্ধু একসঙ্গে বসেই ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন। “গাড়ি থেকে নেমে ওই অবস্থা দেখে গলা শুকিয়ে এসেছিল। পা সরছিল না। নীচে ওই দৃশ্য দেখে পিছিয়ে আসার সময়ে আচমকাই মনে হল, পায়ের তলায় উড়ালপুলের অংশও তো যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে!” পা টিপে টিপে গাড়িয়ে উঠে বসেন তাঁরা। অসিত সন্তর্পণে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নেন। খুব ধীরে গাড়ি নিয়ে নামতে গিয়ে দেখেন আর একটা গাড়ি তীর বেগে উঠে আসছে পুলের উপরে। তখনই সম্বিত ফিরে পান চার যুবক। গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে পাগলের মতো চিৎকার করতে শুরু করেন। দাঁড় করিয়ে দেন উল্টো দিক থেকে আসা গাড়িটি। সামনে বিপদ দেখে গাড়িটা মুখ ঘুরিয়ে সেতু থেকে নেমে অন্য রাস্তা ধরে। কিন্তু পা আটকে যায় পালানদের।
তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। পালানরা বুঝতে পারেন, স্বার্থপরের মতো তাঁরা গাড়ি নিয়ে চলে গেলে চরম বিপদের মুখে পড়তে পারেন অনেকেই। রাতের ফাঁকা রাস্তায় কর্কশ আওয়াজ তুলে প্রবল গতিতে ছুটে আসছে একের পর এক গাড়ি। ভিআইপি ছেড়ে উঠে আসতে চাইছে উড়ালপুলে। আর প্রবল গতিতে উড়ালপুলে উঠলেই বাঁকের মুখে কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়িগুলো পড়ে যেতে পারে নীচে!
কী হবে তা হলে? নিজেদের গাড়িটা নীচে নামিয়ে এনে আড়াআড়ি ভাবে উড়ালপুলের মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেন অসিত। অন্ধকারের মধ্যেই হাতের সামনে যা পাওয়া গিয়েছে তাই জড়ো করে আনলেন পালান, অমিত, সজল। ভাঙা রেলিং, হোর্ডিং, গাছের ডাল এনে গাড়ির সামনে রেখে প্রাচীর তৈরি করলেন। নিজেরা হাতে তুলে নেন পাতা ভরা গাছের ডাল। প্রাণপণে নাড়তে থাকলেন ডালগুলো। পালানের কথায়, “তখনও ভয়ে পা কাঁপছিল।”
এ ভাবে প্রায় মিনিট দশেক ধরে ঠিক কতগুলো গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা, তা আর সঠিক মনে নেই। সজলের কথায়, “প্রায় ৩০-৩৫টি গাড়ি তো হবেই। লরি, ছোট লরি, বাস, ছোট গাড়ি ছাড়া কল সেন্টারের গাড়িও ছিল। একটাকেও উড়ালপুলে উঠতে দিইনি। আমাদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। আমরা সবাই মিলে উড়ালপুলের মুখে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো চিৎকার করে যাচ্ছিলাম।” এ ভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পরে লেকটাউনের দিক থেকে প্রথম আসেন দু’জন কনস্টেবল। তাঁরা এসেছিলেন কল সেন্টারের গাড়িতে। তারও পরে আসে পুলিশের দু’টি জিপ। নিজেদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পান ওঁরা চার জন।
এক জন স্নাতক, বাকি তিন জনের পড়াশোনা অষ্টম ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত। পালানের আক্ষেপ, “দত্তাবাদে থাকি। ছোটখাটো চাকরি করি। লোকে নিচু চোখে দেখে।” কিন্তু ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাঁদের চার জনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন পুলিশ অফিসার। এক গাল হেসে অমিত বলেন, “যাক! উনি তো আর আমাদের অবজ্ঞা করে ঠেলে সরিয়ে দেননি!” এটাই এখন সবচেয়ে বড় পাওনা চার যুবকের কাছে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.