বসতভিটের বাজার ছাই, মৃত ১৯
নামার জন্য একটিমাত্র সিঁড়ি। মুখেই দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। চারদিক ভরে গিয়েছে কালো ধোঁয়ায়। প্রাণপণ চেষ্টা করেও মেজেনাইন ফ্লোর (দেড়তলা) থেকে নামতে পারছেন না কেউ।
একতলার অবস্থাও একই রকম। বাইরে বার হওয়ার পাঁচটি দরজার মধ্যে চারটিই বন্ধ। ধোঁয়ার মধ্যে বেরনোর পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই। শেষ পর্যন্ত সামলে দমকলের উদ্ধারকারীরা যখন ভিতরে ঢুকলেন তত ক্ষণে সব শেষ। সিঁড়ির আশপাশ ও একতলার বন্ধ দরজার সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মৃতদেহের সারি। কেউ মারা গিয়েছেন দমবন্ধ হয়ে, কেউ বা আগুনে ঝলসে। দিনের শেষে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৯। মিলেছে আরও একটি দেহাংশ। আহত চার। মঙ্গলবার রাতে শহরের আগুনের ইতিহাসে ঢুকে পড়ল শিয়ালদহের সূর্য সেন বাজারের নাম।
তিন বছর আগে পার্ক স্ট্রিটে স্টিফেন কোর্টের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি যেন। সেখানেও আগুন লাগার পরে নীচে নামতে না পেরে অসহায় বাসিন্দারা ছুটেছিলেন ছাদের সিঁড়ি দিয়ে। কিন্তু ছাদের দরজা বন্ধ থাকায় তাঁদের আর বেরিয়ে আসা হয়নি। সিঁড়িতেই গাদাগাদি করে পড়ে ছিল মৃতদেহগুলি।
মঙ্গলবার রাতে আগুন লাগা পাঁচতলা বাড়িটি শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সূর্য সেন স্ট্রিটে ঢুকতেই প্রথমেই চোখে পড়ে। বাড়িটির সামনের দিকের অংশে রয়েছে একটি গেস্টহাউস। পাশের অংশের এক তলায় রয়েছে প্লাস্টিক, থার্মোকল, পিচবোর্ডের তৈরি বিয়ে বাড়ির বিভিন্ন উপকরণ, ছাপাখানা, কাগজপত্রের দোকান ও গুদাম। একতলা রয়েছে একটি সব্জি বাজার, দু’টি কেরোসিন তেলের দোকান, হোটেল, মুদিখানা-সহ অন্যান্য দোকানও। দেড়তলায় পায়রার খোপের মত প্রায় ৮০টি ঘর। এক তলা থেকে এই মেজেনাইন ফ্লোরে ওঠার জন্য রয়েছে একটি সংকীর্ণ সিঁড়ি।
তবে একতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য বাড়িটির অন্য দিকে (এপিসি রোড ও সূর্য সেন স্ট্রিট) আরও দু’টি সিঁড়ি রয়েছে। যদিও তার সঙ্গে দেড়তলার ওই অংশের কোনও সংযোগ নেই। একতলা থেকে বার হওয়ার জন্য রয়েছে পাঁচটি দরজা। আগুন লাগার পরে এই পাঁচটির মধ্যে মাত্র একটির চাবি খুলতে পারেন বাজারের কেয়ারটেকার। তাতে বাঁচে কিছু মানুষের প্রাণ।
কারা ছিলেন ওই বাড়িটিতে? ওই বাজারের ব্যবসায়ী ও আগুনের কবল থেকে বেঁচে ফেরা লোকেরা জানিয়েছেন, দেড়তলায় প্লাস্টিক, কাগজ, থার্মোকল ইত্যাদি জিনিসপত্রের গুদাম, ছাপাখানা রয়েছে। কাজের পরে রাতে সেখানেই শুয়ে পড়তেন কর্মী ও দোকান মালিকদের একাংশ। আবার বাইরের কিছু হকারও শুতে আসতেন সেখানে। একতলা ও দেড়তলা মিলিয়ে রাতে ৪০-৫০ জন লোক ওই বাড়িতে শুতেন বলে এলাকার মানুষ জানিয়েছেন।
কী ঘটেছিল রাতে?
নামিয়ে আনা হচ্ছে মৃতদেহ। বুধবার ভস্মীভূত সূর্য সেন মার্কেটে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
ঘটনার সময়ে একতলায় ছিলেন বাড়িটির বাজারের কেয়ারটেকার শম্ভু পণ্ডা। তিনি বলেন, “রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ দম আটকে আসায় ঘুম ভেঙে যায়। দেখি, চার দিক কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে। সিঁড়ির কাছে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। এর মধ্যে একতলার অনেকে চিৎকার করছেন। আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি দেড়তলা থেকেও।” শম্ভুবাবু বলেন, “কী করতে হবে বুঝতে পারছিলাম না। যখন পালাতে হবে বুঝতে পারলাম, তখন চেঁচিয়ে অন্যদের ডাকতে শুরু করলাম। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। এপিসি রোডের দিকের গেটের চাবিটিই আমার কাছে ছিল। হাতড়ে হাতড়ে কোনও রকমে সেই দরজা খুলে কয়েক জনকে নিয়ে বাইরে এলাম।” একতলায় থাকা মহমম্দ শাকিলও এ ভাবেই বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেন, “সিঁড়ির দিক থেকে আগুন লেগেছিল। তাই সিঁড়ি দিয়ে কেউই নামতে পারেননি।”
মরণফাঁদ। বিস্তারিত...
দেড়তলায় তখন কী অবস্থা?
“ঘুম ভাঙতেই মনে হল, দমবন্ধ হয়ে আসছে। কোনও মতে ছুটে সিঁড়ির কাছে যাই। দেখি, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। চার দিকে ধোঁয়া,” বলছিলেন রাজা দে। দেড়তলার এক ছাপাখানার কর্মী। কোনও মতে ঝাঁপ মেরে প্রাণে বেঁচেছেন তিনি। একফালি বারান্দায় এসে একটি ঘরের খোলা জানলা দেখতে পান রাজা। সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে টিনের শেডে পড়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি।
সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির চার দিকে পুলিশ, দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ছোটাছুটি। ভাঙা হচ্ছে দেওয়াল, জানলা। গ্যাস কাটার দিয়ে কাটা হচ্ছে বন্ধ দোকানের শাটার। আহতদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নীলরতন সরকার হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বাড়ির এক একটি গেটের সামনে দাঁড়ানো অ্যাম্বুল্যান্স। প্লাস্টিকে মুড়ে একের পর এক নামানো হচ্ছে কালো হয়ে যাওয়া দেহগুলি। অ্যাম্বুল্যান্সে তুলেই সাইরেন বাজিয়ে তা চলে যাচ্ছে হাসপাতালের দিকে। বাতাসে তখনও মাংস-পোড়া গন্ধ। বাড়িটির উল্টো দিকে বসে ছিলেন শেখ সালাউদ্দিন। তিনি বলেন, “ফুটপাথে ঘুমোচ্ছিলাম। আচমকা ‘আগুন আগুন’ চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে দেখলাম, কয়েক জন লোক গায়ে আগুন নিয়ে ছুটে বেরোনোর চেষ্টা করছেন।”
এ দিন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে দমকলের এডিজি গোপাল ভট্টাচার্য বলেন, “চারটের সময়ে দমকল ঘটনাস্থলে আসে। আগুন নেভাতে ২৬টি ইঞ্জিন নামানো হয়। আগুন নিভে যায় সকাল ৭টা নাগাদ। কিন্তু বাড়িটি ঠান্ডা করার জন্য আরও কয়েক ঘণ্টা জল ঢালতে হয়।” কী করে আগুন লাগল তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি। সন্ধ্যায় ফরেন্সিক টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত চালায়। প্রাথমিক তদন্তে তাঁদেরও অনুমান, একতলার সিঁড়ির নীচেই আগুন লাগে।
দমকল-কর্তারা জানান, গোটা বাড়িতে আগুন নেভানোর কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। দেড়তলার ঘরগুলিও কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই তৈরি করা হয়েছে বলে দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান জানিয়েছেন। তিনি জানান, বাড়িটি বেআইনি। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, এ ব্যাপারে এত দিন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? দমকলমন্ত্রী বলেন, “এটা দমকলবাহিনীর কাজ নয়। পুরসভা এ ব্যাপারে কী করেছে, তা পুরসভাই বলতে পারবে।” কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এ ব্যাপারে বলেন, “এই বাড়িটি ৫০ বছরের পুরনো। রেকর্ড না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।” তবে পুরসভা সূত্রের খবর, বাড়িটি পুরসভার নথিতে বসতবাড়ি হিসাবেই দেখানো রয়েছে। তবে ওই বাড়িতে ১৩৬টি ‘ট্রেড লাইসেন্স’ দিয়েছে পুরসভা।
বেলা বাড়তে একে একে ঘটনাস্থলে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র প্রমূখ। মৃতদের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা করে এবং জখমদের ৫০ হাজার টাকা করে সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যপাল বলেন, “মর্মান্তিক ঘটনা। বড় ক্ষতি হল।” বেআইনি নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এখন কোনও মন্তব্য করব না।” চাপানউতোরের বাইরে গিয়ে সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “এখন দোষারোপের সময় নয়। আগে মানুষকে উদ্ধার করতে হবে।”
রাতে এই ঘটনা নিয়ে মুচিপাড়া থানায় একটি মামলা দায়ের করে দমকল। দমকলকর্তারা জানান, বাড়িটির তিন জন মালিক (শৈলেন সাহা, রতন সাহা এবং মানিক সাহা) ও বাড়িটির কেয়ারটেকার দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। দমকল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, বাড়ির মালিকেরা ‘ফায়ার লাইসেন্স’-এর শর্ত মানেননি। বহুতল ও ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ি তৈরির নিয়মও মানা হয়নি। তাই ওই চার জনের নামে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। কলকাতা পুলিশের ডিসি (সেন্ট্রাল) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ জানান, অভিযুক্তদের এখনও ধরা যায়নি।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.