আ-এ আলাং, ই-তে ইপিল, সাঁওতালি শিশু চায় সহজপাঠ
বীরভূমের ঝাড়খণ্ড সীমানার প্রাম্তবর্তী গ্রাম গড়িয়া। কয়েক ঘর বাঙালি ও বাকি দেড়শো সাঁওতাল পরিবার। পাথর খাদান অঞ্চলের সাঁওতাল গ্রামবাসীর জীবনযাপনে প্রবেশ করার তাগিদে শিশুশিক্ষাকে মাধ্যম করে জনসংযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন ‘উৎনৌ’ সংস্থার কুণাল দেব। দেখেছিলেন, প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডী পেরোনোর আগেই গ্রামের ৮৫ শতাংশ সাঁওতাল ছেলেমেয়ে স্কুলছুট। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া ছেলেমেয়েরা যুক্তাক্ষর পড়তে পারে না। পাঠ্যবইয়ের লাইন ধরে-ধরে মুখস্থ করে, কিন্তু মানে বোঝে না।
“শিশুদের পড়াতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম, ভাষাগত ব্যবধানটাই মূল সমস্যা,” বলেন কুণালবাবু। “সাঁওতালি ভাষায় ‘আম’-এর অর্থ ‘তুমি’। বাংলা ‘আম’কে সাঁওতালি ভাষায় বলে ‘উল’। এ বার এক জন সাঁওতাল শিশুর চোখ দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করুন! ‘উল’-এর ছবি দেখিয়ে শিক্ষক বললেন ‘আম’! অবাক শিশু কিছু বুঝতে পারে না। শিক্ষক বিরক্ত হন, গাল পাড়েন। পিঠে বেত পড়ে এবং শিশুরা স্কুলছুট হয়।”
এখানেই শেষ নয়। সদ্য পড়তে শেখা সাঁওতাল শিশুর সামনে রাখা হয় বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের গদ্য। তার বাংলা উচ্চারণের জড়তা তার বাঙালি শিক্ষক ও সহপাঠীদের হাসির বিষয় হয়ে ওঠে। তাই উত্তর জানা থাকলেও শিক্ষকের প্রশ্নে নিরুত্তর থাকে সে। আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকে।
চাই বই, চাই শিক্ষা। রাজ্য যাঁরা চালান, দরকার তাঁদের সদিচ্ছাও।—ফাইল চিত্র।
স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের জন্য ‘উৎনৌ’ সংস্থার উদ্যোগে যখন সাঁওতালি মাধ্যম স্কুল শুরু হল, দেখা গেল মাত্র তিন থেকে চার মাসের মধ্যে সকলে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ লিখতে ও পড়তে শিখে গেল। “অ-তে অজগর না বলে আমরা ‘অত’ (মাটি), আ-তে ‘আলাং’ (জিভ), ই-তে ‘ইপিল’ (তারা) ইত্যাদি শিখিয়েছিলাম শুধু। দেখা গেল এক বছরের মধ্যে প্রত্যেকে বই পড়তে শিখে গেল। নিজেরা গল্প লিখল। প্রথমে সাঁওতালি ভাষায়। তারপর বাংলায়। এখন ইংরেজিতেও লিখছে,” বললেন কুণালবাবু।
একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসে বাঙালি প্রায়ই ভুলে যায় সেই ছেলেমেয়েদের, যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। পুরুলিয়ায় ২০০৪ সাল থেকে অল ইন্ডিয়া সাঁওতালি এডুকেশন কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে এ রাজ্যেও সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি হরফে পঠন-পাঠন শুরু হয়েছে ৬৪টি স্টাডি সেন্টারে। কাউন্সিলের পুরুলিয়া জেলার কো-অর্ডিনেটর গণেশচন্দ্র মুর্মু জানান, বিভিন্ন স্কুলে শুধু রবিবার ক্লাস হয়। কোনও সরকারি সাহায্য নেই। পড়ুয়াদের দেওয়া টাকাতেই শিক্ষকদের পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা। গণেশবাবু বলেন, “আমরা সকলকে বুঝিয়েছি, মাতৃভাষার জন্য অন্তত এটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।”
তবে উৎসাহে খামতি নেই পড়ুয়াদের। এই স্টাডি সেন্টারগুলিতে গত বছর পর্যন্ত ৩ হাজার পড়ুয়া পাঠ নিয়েছে। এই সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। কিন্তু ঠিক সময়ে বই পাওয়া যায় না। তৃণমূলের সরকার জঙ্গলমহলের নয়টি ব্লকে প্রাথমিক স্কুলে অলচিকি হরফে পড়ানোর জন্য কিছু পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ করেছে গত মে মাসে। কয়েকটি স্কুলে পড়াশোনাও শুরু হয়েছে এই বছর থেকে। কিন্তু অনেকের কাছেই বই পৌঁছয়নি। গণেশবাবুর অভিযোগ, বই না-পাওয়া এবং অন্য নানা সমস্যার কারণে সাঁওতালি ভাষার শিক্ষকেরাও বাংলা মাধ্যমের বই-ই পড়াচ্ছেন পড়ুয়াদের।
সাঁওতালি ভাষার অনাদর উচ্চশিক্ষাতেও। আদিবাসী প্রথমিক শিক্ষক সংগঠনের পুরুলিয়া জেলা আহ্বায়ক শত্রুঘ্ন মুর্মুর আক্ষেপ, কলেজের পরীক্ষাতেও হাতে লেখা প্রশ্নপত্রে ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিচ্ছেন। সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জেলার পাঁচটি কলেজে সাঁওতালি ভাষা পড়ানো হয় অলচিকি হরফে। কিন্তু হাতে-লেখা প্রশ্নপত্রে তাঁদের পার্ট ওয়ান পরীক্ষা হয়েছিল। প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে অবশ্য জানানো হয়েছে, ছাপাখানার অভাবেই প্রথমে হাতে-লেখা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়েছিল। পরে ছাপানো প্রশ্নে ফের পরীক্ষা হয়েছে।
শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ, বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আদিবাসী শিশু-কিশোরদের সেই স্বাভাবিক পুষ্টি জোগানোর থেকে আজও অনেক দূরে রয়ে গিয়েছে এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.