সরকারি মঞ্চে রাজনীতি নিয়ে তরজা
মাটি উৎসবেও স্টল খুলল তৃণমূল মুখপত্র
রকারি অনুষ্ঠানে কোনও রকম রাজনৈতিক স্লোগান চলবে না বলে কয়েক দিন আগেই পাহাড়ে এক উৎসবের মঞ্চে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ বার রাজ্য সরকার আয়োজিত, তাঁর প্রাণের মাটি উৎসবেই সেজে উঠল তৃণমূলের দলীয় মুখপত্রের স্টল।
বইমেলায় গ্রামের খোড়ো চালাঘরের আদলে গড়া নিজের দলের ‘জাগো বাংলা’ পত্রিকার স্টলটির প্রশংসা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বইমেলা শেষের পরে রাত পোহাতেই ‘জাগো বাংলা’কে মাটি উৎসবের মাঠে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তৃণমূল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা দোলা সেন সোমবার সকালে হাজির হন পানাগড়ের কাছে বিরুডিহা গ্রামে। আজ, মঙ্গলবার, উৎসবের চতুর্থ দিন থেকেই স্টলটির দেখা মিলবে। ৩০ জানুয়ারি দার্জিলিঙের ম্যালে উত্তরবঙ্গ উৎসবের মঞ্চে গোর্খা মুক্তি মোর্চার সমর্থকদের দলীয় স্লোগান দিতে নিষেধ করেছিলেন মমতা। সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি যে দলের কর্মসূচি বরদাস্ত করবেন না এবং এ ব্যাপারে তিনি যে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’, স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশ্ন উঠেছে, সেই মুখ্যমন্ত্রীরই অন্য একটি উৎসবে তাঁর দলের মুখপত্রের স্টল কেন?
হাতে গোনা শ্রোতার সামনেই বাউল গানের আসর।
সোমবার পানাগড়ে মাটি উৎসবে বিকাশ মশানের তোলা ছবি।
মমতার দলের মুখপাত্র তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিন্তু মাটি উৎসবের মতো সরকারি অনুষ্ঠানে দলীয় মুখপত্রের স্টল করার মধ্যে অনুচিত কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। পার্থবাবুর কথায়, “দলীয় মুখপত্র আবার কী! কিছু সংবাদপত্র ও চ্যানেলকেও তো কোনও কোনও দলের মুখপত্র বলে মনে হয়। আগেও তো সরকারি অনুষ্ঠানে মার্ক্সীয় সাহিত্যের বই দেখা যেত। এটাও তেমনই।” মা-মাটি-মানুষের ধ্বনি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন মমতারা। তার সঙ্গে যোগসূত্রের ইঙ্গিত দিয়ে পার্থবাবু বলেন, “তা, মাটির সঙ্গে কি বইয়ের যোগ নেই!” স্টলের দায়িত্বে থাকা দোলাদেবী এই নিয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বলবেন না বলে জানিয়ে দেন। আর উদ্যোক্তারা জানান, মাটি উৎসবে তৃণমূলের দলীয় মুখপত্রের স্টলে মমতার সব বই-ই থাকবে।সরকারি মাটি উৎসবে ‘জাগো বাংলা’র যোগ নিয়ে অবশ্য প্রত্যাশিত ভাবেই সরব হয়েছে বিরোধী সিপিএম। ওই দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব যেমন বলছেন, “দল আর সরকারের কর্মসূচিতে কোনও ফারাক দেখা যাচ্ছে না। মাটিকে নিয়ে এ রাজ্যে প্রবঞ্চনা-প্রতারণা চলছে।” পার্থবাবুর বক্তব্য, আগেও পাড়ায় পাড়ায় পুজোয় মার্ক্সবাদী সাহিত্যের স্টল থাকত। এখন ওদের ক্ষমতা গিয়েছে, ক্লাব গিয়েছে, সব গিয়েছে। সংবাদপত্রের উপরে নির্ভর করে চলতে হচ্ছে।” সিপিএমের উদ্দেশে তাঁর টিপ্পনী, “তা, ওঁরা তো মাটি উৎসবের উদ্যোক্তাদের কাছে দলীয় মুখপত্রের স্টলের জন্য আবেদন করে দেখতে পারতেন! জানি না, উদ্যোক্তারা কী সিদ্ধান্ত নিতেন।”
পটে লিখা
বানানো হচ্ছে ‘জাগো বাংলা’র স্টল। পটচিত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পানাগড়ের মাটি উৎসবে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এ দিন দুপুর থেকেই বইমেলায় জাগো বাংলার স্টলটিকে মাটি উৎসবের মাঠে বসানোর কাজ শুরু হয়ে গেলেও বর্ধমানের জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মীনা এই নিয়ে কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, “ওয়েবসাইটে যা বলা আছে, তার বাইরে মাটি উৎসব নিয়ে কিছু বলার নেই।” আর উৎসবের নোডাল অফিসার তথা কৃষিসচিব সুব্রত বিশ্বাস বলেন, “জাগো বাংলার স্টলের বিষয়টি আমায় কেউ জানায়নি। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।”বইমেলার মাঠে তৃণমূলের দলীয় মুখপত্রের স্টল গড়তে খরচ হয়েছিল দু’লক্ষাধিক টাকা। লরিতে সেই স্টলের যাবতীয় সরঞ্জাম উঠিয়ে এনে বিরুডিহায় লালবাবার আশ্রমের মাঠে ফেলে নতুন করে গড়া হচ্ছে। স্টলটি কলকাতার পুজোর পরিচিত থিম-শিল্পী অনির্বাণ দাসের পরিকল্পনাপ্রসূত। বই ছাড়াও ওই স্টলের অন্যতম আকর্ষণ পটকথায় মুখ্যমন্ত্রী মমতার সাফল্যের উপস্থাপনা। পিংলার শিল্পীদের দিয়ে আঁকানো হয়েছে। বিকেলে মেলার মাঠে নির্মীয়মাণ স্টলের আশেপাশে পটে দেখা গেল সবুজ পাড় আর সাদা শাড়ির মুখ্যমন্ত্রীকে। কোনও ছবিতে তিনি বাজারে ঢুকে সব্জি বিক্রির তদারক করছেন। কোথাও চাষি, গ্রামের শ্রমিক, লোকশিল্পী কিংবা মহিলা ক্রিকেটারদের মধ্যে মমতা। অনির্বাণ বললেন, “গত দু’বছরে মুখ্যমন্ত্রীকে যেমন দেখা গিয়েছে, তেমনটাই উঠে এসেছে পটে। যেমন আমরি হাসপাতালে পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন বা মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা ঠেকাতে ঢুকে পড়ছেন বাজারে। কৃষি, ক্রীড়া, সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানা টুকরো দৃশ্যই পটকথার প্রেরণা।”
আর শিল্প?
পটের ছবিতে শিল্প দেখানোটা মুশকিল, জানাচ্ছেন অনির্বাণ। ভাঙড়ের জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিনই নতুন এক শিল্প সৃষ্টির কথা বলেছেন। ঝুলন-শিল্প! মাটি উৎসব বা যাত্রা উৎসব নিয়ে সমালোচকদের কটাক্ষের জবাবে তিনি বলেন, “মাটি উৎসব ও যাত্রা উৎসবকে ব্যঙ্গ করে ঝুলন বলা হচ্ছে। তা, ঝুলনও তো শিল্প। আমরা ঘরে ঘরে ঝুলন সাজাতাম।” শিল্পের এই ব্যাখ্যা শুনে মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকারের শিল্প-ভাবনা আদতে ঠিক কেমন, অনেকের কাছেই আবার তা গুলিয়ে যাচ্ছে। সিপিএমের রবীনবাবু যেমন বলেন, “এই উৎসব কোন মাটির শিল্প, মাথায় ঢুকছে না। বেলে মাটি না পোড়ামাটি, কাদামাটি না লাল মাটি বোঝা যাচ্ছে না!”
উৎসবের চরিত্র বা শিল্পের ব্যাখ্যা নিয়ে এই তরজার মধ্যেই যে-কোনও গ্রামীণ মেলার মেজাজে নাচে-গানে কেনাকাটায় মাটি উৎসব জমজমাট।

ফেসবুকে মাটি
মাটি উৎসব এ বার ফেসবুকেও। মুখ্যমন্ত্রীর নিজের প্রোফাইলে উৎসবের উদ্বোধনী আসরের ছবির ছড়াছড়ি ছাড়াও জেলা প্রশাসনের কর্তাদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে নতুন গ্রুপ, মাটি উৎসব ২০১৩। একটি গাছের ছবি দেওয়া গ্রুপে থাকছে রোজকার কর্মকাণ্ডের সচিত্র ফিরিস্তি। ফেসবুকে যাঁরা আছেন, মাটি উৎসবের বিষয়ে জানতে তাঁরা এই গ্রুপে যোগ দিতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রীর ছবির অ্যালবামে এই উৎসবের ছবি দেখে তাঁকে অভিনন্দন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছু তির্যক মন্তব্যও অবশ্য দেখা যাচ্ছে।

হরেক মাটি
জঙ্গলমহলের লাল মাটি, পুরুলিয়ার হলদেটে ধূসর বা দার্জিলিঙের কালচে জৈব মাটি একজোট। ছোট্ট একটি টেবিলে বাংলার বিভিন্ন জেলার মাটি-বৈচিত্র সাজিয়ে বসে আছেন কেন্দ্রীয় কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞেরা। ‘ভিজিটর্স বুক’-এ এই সংগ্রহের ভূয়সী প্রশংসায় মুখ্যসচিব-সহ বহু আমলা। শুধু শাড়ি-পাঞ্জাবির রঙে নয়। মাটি উৎসবে সত্যিকার মাটি থাকবে না, তা কী হয়! আয়োজকেরা কিন্তু বলে দিচ্ছেন, এ মাটি শুধুই দ্রষ্টব্য। বিক্রয়যোগ্য নয়।

ধান-শ্রী
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর স্বহস্তে ধানচারা রোপণের ছবি শোভা পাচ্ছে মেলার মাঠে। মুখ্যমন্ত্রীর নিজের হাতে পোঁতা ধানচারার পঙ্ক্তিটিকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি বিষয়ক উপদেষ্টা প্রদীপকুমার মজুমদার ‘ম্যাডাম’-এর কৃষিকাজে মুগ্ধ। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, গুচ্ছ গুচ্ছ না-ধরে ধানচারা একটি একটি করে বসাতে হয়। ধান চাষের এই পদ্ধতির নাম শ্রী-বিধি। ধানের ফলন বাড়াতে চাষিদের মধ্যে শ্রী-বিধির প্রসার চায় রাজ্য। কৃষি দফতরের ভাবনা, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ছবিই হবে বিজ্ঞাপনের মুখ।

উপেক্ষিত
মন ভাল নেই বিরুডিহার। সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সর্বত্র মাটি উৎসবে ‘পানাগড় চলুন’ ডাক। কিন্তু ক’জন জানে, যেখানে উৎসব হচ্ছে, সেই গ্রামের নাম বিরুডিহা! অখ্যাত গাঁয়ে সহজে বাস থামতে চায় না। কৃষিজমিতে সেচ থেকে শুরু করে ডাক্তার-হাসপাতালের হাজারো সমস্যা। গ্রামবাসীদের আশা, উৎসবের কল্যাণে যদি কিছু আনুকূল্য জোটে বরাতে।

বহুরূপী
গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি করছেন পক্বকেশ রবীন্দ্রনাথ। ‘হে মোর চিত্ত পুণ্যতীর্থে জাগো রে ধীরে...।’ আলাপ হতে নিজের কার্ড এগিয়ে দিলেন। তাতে লেখা আন্তর্জাতিক বহুরূপী শিল্পী। আসল নাম সুবল দাস বৈরাগ্য। তিন দশক আগে ভারত উৎসবে ওয়াশিংটন ডিসি-ও ঘুরে এসেছেন সত্তরোর্ধ্ব সুবলবাবু। সাকিন নানুর। আপাতত থিতু হয়েছেন মাটি উৎসবে।

বানাম
দেখতে অনেকটা বেহালার মতো। আওয়াজটা অন্য রকম। ছড় টেনে কাঠের বাদ্যযন্ত্রটিকে কথা বলাচ্ছেন পুরুলিয়ার গড়জয়পুর ব্লকের জাহাজপুর গ্রামের নরেন হাঁসদা। মাটি উৎসবের জন্য সাঁওতালি সেরেঞ-এর একটি বঙ্গানুবাদও সুরে সুরে পেশ করা হচ্ছে। বন-জঙ্গল-পাহাড় কোণে/আদিবাসী দলে দলে খোঁপা বাঁধে বনফুলে। সাঁওতালি বিয়ের নাচ-গানের সঙ্গে বাজছে বিরল ওই বাদ্যযন্ত্র। নাম তার বানাম।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.