ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ঐতিহাসিক নজির গড়িল। মঙ্গলবার সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সমকামী বিবাহ বৈধতা লাভ করিল। এমন একটি তীব্র সামাজিক বিভাজনকারী বিষয়ে এমন আইন পাশ করা যাইবে কি না, তাহা লইয়া যথেষ্ট অনিশ্চয়তা ছিল। শেষ পর্যন্ত সাফল্য যে পথে আসিল তাহাও কম ঐতিহাসিক নহে। কনজারভেটিভ পার্টির প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নিজের দলের অর্ধাংশ, শরিক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাট ও বিরোধী দল লেবার পার্টির সঙ্গে হাত মিলাইয়া বিলটির পক্ষে ভোট দিলেন। কনজারভেটিভ পার্টির বাকি অর্ধাংশ রক্ষণশীলতার প্রবহমান ধারা আঁকড়াইয়া সমকামী বিবাহের বিরুদ্ধেই ভোট দিল। অর্থাৎ আইনসভায় প্রধান শাসক দল আড়াআড়ি বিভক্ত হইয়া গেল। ব্রিটেনের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ভারতের মতো দেশে তো কথাই নাই। যে দেশে সংসদ কথায় কথায় পার্টি হুইপের ব্যবহার দেখিয়া অভ্যস্ত, গুরুতর সামাজিক প্রশ্নে দলের দ্বিভাজন সেখানে অভাবনীয়। অথচ ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ কথাটি সত্য অর্থে মানিলে ইহা অত্যন্ত স্বাভাবিক হওয়ারই কথা ছিল।
কেবল তাহাই নহে, কখনও কখনও সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের সহিত হাত মিলানোও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হইবারই কথা ছিল। বিতর্ক ও ভোটাভুটি যখন বিষয়ভিত্তিক, কোনও ব্যক্তি-প্রতিনিধির মত কোনও বিশেষ বিষয়ে তাঁহার দলীয় মত অপেক্ষা বিরোধী দলের মতের কাছাকাছি: এমন তো হইতেই পারে! অথচ ভারতের মতো দেশে দেখা যায়, দল একেবারে সর্বগ্রাসী, ব্যক্তির বিচার-বিবেচনা কদাপি দলের বিবেচনা অতিক্রম করিতে পারে না। ভারতের সংসদীয় পদ্ধতি যতটা দলতান্ত্রিক, ততটা গণতান্ত্রিক নহে। যে ব্যবস্থায় কোনও ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি হইলেও তাঁহার নিজ ইচ্ছা বা মতের গুরুত্ব শূন্য, তাহা প্রকৃত গণতন্ত্র হইতে পারে না। ওয়েস্টমিনস্টার ধারা হইতেই ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ, কিন্তু এখনও যে সংসদীয় আচারবিচারে এ দেশ কতটাই পিছাইয়া আছে, তাহা এই একটি ঘটনাই বুঝাইয়া দেয়।
ক্যামেরনের পক্ষেও এই কাজ সহজ ছিল না। তাঁহার বিরুদ্ধে দলকে বিভক্ত করিবার অভিযোগ, সামাজিক কাঠামো বিনষ্টির অভিযোগ। ক্যামেরন কিন্তু অটল ভঙ্গি ও দৃপ্ত উচ্চারণে জানাইয়াছেন, দলের বাকি সদস্যরা একমত না হইলেও তিনি ও তাঁহার অনেক সতীর্থ কিন্তু বিরোধীদের মতোই মনে করেন, ‘ভিন্ন’ গোত্রের বিবাহে স্বীকৃতির মাধ্যমে তাঁহার দেশ সম্মুখের দিকে কয়েক পা আগাইয়া গেল। এই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ২০১০ সালে যখন নিক ক্লেগ-এর অধিনায়কত্বে বাম-ভাবাপন্ন লিবারেল ডেমোক্র্যাটের সহিত হাত মিলাইয়া ক্যামেরনের কনজারভেটিভ পার্টি সরকার গঠন করিয়াছিল, তখন অনেকেই ইহাকে আদর্শবিহীন সংসদীয় সুবিধাবাদিতা বলিয়া গাল দিয়াছিলেন। একটি পদক্ষেপেই সকল অভিযোগ অসার প্রমাণিত করিলেন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন। বুঝাইয়া দিলেন, সদিচ্ছা থাকিলে ভিন্নমতাবলম্বী শরিক দল, এমনকী বিরুদ্ধ মতাবলম্বী বিরোধী দলের সঙ্গেও হাত মিলাইয়া সদর্থক কাজ করা যায়। |