সম্পাদকীয় ১...
অধিকার ও দায়িত্ব
থায় কথায় এফ আই আর ঠুকিয়া জেলে পুরিবার হুমকি ভারতীয় গণতন্ত্রের মজ্জাগত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আশিস নন্দীর জয়পুর-ভাষণ লইয়া আর এক বার সেই একই কুনাট্য। দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে দুর্নীতি বেশি (কিংবা বেশি প্রত্যক্ষগ্রাহ্য) এবং পশ্চিমবঙ্গে দলিত রাজনীতির গুরুত্ব কম বলিয়াই দুর্নীতি কম— এই সকল বাক্য (কিংবা দুর্বাক্য) বলিবার অপরাধে তাঁহার নামে পুলিশে ডায়েরি হইল, গ্রেফতারের দাবিতে জনতা ও জনপ্রতিনিধিরা উন্মত্ত হইয়া উঠিলেন। শেষ পর্যন্ত এই হুমকি/দাবি কত দূর কার্যে পরিণত হইবে, অনিশ্চিত। কিন্তু জয়পুরের সাহিত্যসভায় দেশবিদেশের অভ্যাগতদের সামনে এমন হুমকি যে চতুর্দিকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হইতে পারিল, জননেতাদের বদান্যতায় পুষ্ট হইল, তিপ্পান্নতম বার্ষিকী উদ্যাপনকালে প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ইহাই তো অতীব লজ্জাজনক। ভারতীয় রাষ্ট্র ও সমাজ, উভয়েরই অবিলম্বে ভাবিয়া দেখা উচিত, সহনশীলতার এই হাল লইয়া ভারত কী ভাবে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারের বড়াই করিবে। অধিকারের অর্থ তো তিপ্পান্ন বৎসর আগে সংবিধানেই ব্যাখ্যা করা হইয়াছিল, যাহার মধ্যে বাক্স্বাধীনতা অর্থাৎ কথা বলিবার মুক্তি একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে বিবেচিত।
সন্দেহ নাই, ভারতীয় গণতন্ত্রের অভূতপূর্ব প্রসার ও ব্যাপ্তির সহিত এই অ-সহনশীলতার সংস্কৃতির মূলগত যোগ। কাহারও সম্পর্কে যে-কোনও সমালোচনাকেই এখন রাজনৈতিক মূলধন করিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িয়া সংকীর্ণ ভোটব্যাঙ্ক পুষ্ট ও তুষ্ট করা যায়। তাই, অগণতান্ত্রিকতার সমস্ত দোষ রাষ্ট্রব্যবস্থার নহে, সমাজকেও এই দোষের সমান ভাগ লইতে হইবে। পুলিশ-প্রশাসন-আদালত যেমন অনেক ক্ষেত্রেই অগণতান্ত্রিক, তেমনই বৃহত্তর সমাজের ভূমিকাও যথেষ্ট সমস্যাজনক। সমাজ যদি এ দেশে প্রত্যহ রাজনীতির প্রয়োজনে সহনশীল সংস্কৃতিতে অন্তর্ঘাত সাধিয়া যায়, এবং নেতৃ-সমাজ ও জন-সমাজ উভয়েই তাহাতে সমধিক আগ্রহ দেখাইয়া যায়, তবে তাহা কেবল রাষ্ট্রব্যবস্থার স্খলন বলিলে তো চলিবে না। রাজনীতিকরা পরিস্থিতিকে কাজে লাগাইবার চেষ্টা করেন ঠিকই, কিন্তু সমপরিমাণ দোষ কি সেই পরিস্থিতিরও নহে, যাহা রাজনীতিকদের অসাধু উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হইবার জন্য সর্বদা উন্মুখ, উদ্গ্রীব হইয়া থাকে?
দায়িত্ব প্রসঙ্গে আরও একটি মৌলিকতর দায়িত্বের কথা বলা জরুরি। তাহা নাগরিকের— বিশেষত বিশিষ্ট জ্ঞানী নাগরিকের— দায়িত্ব। বিশিষ্ট নাগরিক যিনি, তাঁহার জানিবার কথা, কোন কথা কোথায় কী ভাবে বলা সমীচীন। যে কথা সারস্বত বিচার ব্যতীত বলা অনুচিত, সারস্বত অঙ্গনের বাহিরে, সারস্বত তথ্য-আবরণহীন ভাবে তাহা বলিলে অনেক সময়ই অগ্রহণযোগ্য ও আপত্তিকর ঠেকিতে পারে। আশিস নন্দীর মতো পণ্ডিত সমাজবিজ্ঞানী যখন দলিত ও অনগ্রসর সমাজ সম্পর্কে এত সংবেদনশীল মন্তব্য করিবেন, উপযুক্ত তথ্য, সংখ্যাতত্ত্ব ও বিশ্লেষণ সহকারেই তিনি তাহা প্রতিষ্ঠা করিবেন, সেগুলি ছাড়া আলটপকা ভাবে করিবেন না, ইহাই প্রত্যাশিত। উপরন্তু এমন বক্তব্য সেই পরিসরেই পেশ করা কর্তব্য যেখানে তাঁহার ভাষা ও ব্যঞ্জনা যথার্থ ভাবে বুঝিতে শ্রোতারা প্রযত্ন করে। যে কোনও জনসভায়, প্রক্ষিপ্ত ভাবে এমন একটি কথা বলিয়া ফেলিলে তাহা নিছক অপ্রয়োজনীয় উশকানি হইয়া দাঁড়ায়। তাঁহার মতো পণ্ডিতরাই তো শিখাইয়াছেন, ভারতীয় বাস্তব কী রকম অতি-বিচিত্রতার অসম সমাবেশ। সেখানে যে কোনও সমাজ বিষয়ে নেতিবাচক কথার গুরুত্ব অনেক, বিপদও অনেক। তাঁহাদের ক্ষেত্রে আবার কথার বিপদ সাধারণের অপেক্ষা বেশি, কেননা তাঁহাদের কথার গুরুত্বও সাধারণের অপেক্ষা বেশি। এই ঝুঁকি মাথায় রাখিয়া চলেন যে বিদ্বান পণ্ডিত, তিনিই দায়িত্ববান নাগরিক। প্রশ্ন উঠিতে পারে, তবে কি অপ্রিয় বা নেতিবাচক কথার পরিসর থাকিবেই না? অবশ্যই থাকিবে। যে বিশিষ্ট নাগরিক সমাজকে শিক্ষিত করিতে পারেন, তাঁহাকেও যেমন দায়িত্ববান হইতে হইবে, একই ভাবে, যে বৃহত্তর সমাজ শ্রোতা বা গ্রহীতার ভূমিকায়, তাহাকেও সহনশীলতার পরিসর বাড়াইতে হইবে। একমাত্র এ ভাবেই গণতন্ত্র সম্ভব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.