সুগত মারজিত প্রশ্ন তুলেছেন, ‘শুধু ভুল ধরে ধরে রাজ্যেরই ক্ষতি হচ্ছে না তো?’ (১৯-১২) অম্বিকেশ মহাপাত্র, শিলাদিত্য চৌধুরী বা টিভি চ্যানেলের সেই ছাত্রীটি, যে কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন করেছিল বলে তাকে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী ‘মাওবাদী’ আখ্যা দিয়ে দেন এঁদের অভিজ্ঞতার কী ব্যাখ্যা দেবেন সুগতবাবু? কিংবা দময়ন্তী সেনকে সরিয়ে দেওয়া? বাম আমলে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রসচিব প্রসাদরঞ্জন রায়কে ঠিক অনুরূপ কারণে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর বয়ানের উলটো কথা বলেছিলেন নন্দীগ্রামের ঘটনা সম্বন্ধে।
সুগতবাবু বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের শ’চারেক কলেজের মধ্যে মাত্র গোটাকয়েক কলেজে ছাত্র-শিক্ষক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। এই নিয়ে সংবাদমাধ্যম অযথা হইচই করছে। যে ঘটনা রায়গঞ্জ কলেজে ঘটেছে, বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা তার বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করেছেন? বরং বলা হয়েছে, কলেজের অধ্যক্ষ নাকি বামফ্রন্টের সমর্থক ছিলেন এবং এখনও তার বিভিন্ন কাজে বামফ্রন্টের প্রতি দৌর্বল্য প্রকাশ পেয়েছে। এটা কি রাজধর্ম? মুখ্যমন্ত্রী সকল পশ্চিমবঙ্গবাসীর অভিভাবক। এই জাতীয় ঘটনাকে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দিলে আগামী দিনে এই উচ্ছৃঙ্খলতা বাকি কলেজগুলোতেও মাথাচাড়া দেবে, এ কথা কি বলে দিতে হবে? ভাঙড়ের স্কুলে আরাবুল ইসলামের অমার্জনীয় ঔদ্ধত্যের পরও ঠিক একই ভাবে ওই শিক্ষিকাকে ‘বামফ্রন্টের সমর্থক’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের যে বীজমন্ত্র সুশাসনের গোড়ার কথা, এই সরকার পদে পদে তার থেকে স্খলিত হয়েছে।
|
সুগতবাবু বলেছেন তোলাবাজি নাকি বন্ধ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এটাও মেনে নেওয়া গেল না। সরকারের সদিচ্ছা আর সততা থাকলে তোলাবাজি সিন্ডিকেট ইত্যাকার দুষ্টক্ষত দূর করতে বেশি দিন লাগে না। যদি তোলাবাজির বখরা থেকে কর্তাব্যক্তিদের পকেট ভারী হওয়ার ব্যবস্থা থাকে, তবে অবশ্য ভিন্ন কথা।
সুগতবাবু ত্রিফলা আলোর কথা লিখেছেন। সেই আলোয় কি সত্যিই কলকাতা কিছুমাত্র সুন্দর হয়েছে? পুরনো ল্যাম্পপোস্টও রইল, আবার ত্রিফলাও হল এ তো তেলা মাথায় তেল দেওয়া। এই বিপুল অপচয় আমাদের মতো গরিব রাজ্যে উচিত?
যারা এক কালে বামফ্রন্টের হার্মাদ বাহিনীতে ছিল, তারাই যে আজ রঙ পাল্টে বর্তমান শাসকদলের পক্ষপুষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষের প্রতি একই রকম অত্যাচার করছে, সে কথা কি নেত্রীর অগোচর? বামফ্রন্টের আমলে যে দলীয় কর্মীরা অত্যাচার সয়ে বর্তমান শাসকদলের হয়ে কাজ করেছিলেন তাঁরা আজ ব্রাত্য। দলে সেই একদা-বামফ্রন্টের হার্মাদদের রমরমা। পাড়ায় পাড়ায় সেই একদা-ভয়ঙ্কর মুখগুলোকে যখন বর্তমান শাসকদলের মন্ত্রী-বিধায়কদের সঙ্গে দেখা যায়, তখন মানুষ আতঙ্কিত হয় আবার বুঝি সেই সব অন্ধকার দিন ফিরে এল।
যে মমতাকে মানুষ ভোট দিয়েছিল, তিনি আর আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা এক মানুষ নন। হতে পারে, তাঁর একার কাঁধে এত বিপুল দায়িত্ব বর্তেছে যে, উনি দিশেহারা হয়ে গেছেন। দলে দ্বিতীয় কেউ নেই, যিনি দলকে টানতে পারেন। কিন্তু দলে যে দ্বিতীয় কোনও মানুষ নেই, এই ব্যর্থতাও তো ওঁরই। উপযুক্ত নেতৃত্ব তৈরি করার কোনও ব্যবস্থাই নেই। কোনও ব্যাপারে কারও কোনও মতামত ব্যক্ত করার উপায় নেই। সব ব্যাপারেই নেত্রী যা বলবেন, সেটাই বেদবাক্য। এই সব ঘটনা মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না? প্রত্যুষ চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা-৬৪
|
তিনি ‘সাধারণ’, সেটাই বঙ্গবাসীর গাত্রদাহের কারণ |
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ: বিরোধী নেত্রীর জার্সি ছেড়ে তিনি এখনও প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারলেন না। এই অভিযোগের পিছনে বাঙালি মানসিকতা কাজ করে। স্বাধীনতার পর থেকে এ রাজ্যে যে ক’জন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, তাঁদের পেডিগ্রি, শিক্ষাদীক্ষা এবং তাঁরা বিলিতি আবহাওয়া এবং আদবকায়দার সঙ্গে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল কি না সেই মাপকাঠিতেই তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা স্থির হয়েছে। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ বেশি দিন টিকতে পারেননি। প্রফুল্লচন্দ্র সেন ‘কাঁচকলা’ মন্ত্রী হিসাবেই কলকাতার অভিজাত মহলে ঠাট্টার পাত্র ছিলেন। আর অজয় মুখোপাধ্যায় তাঁর উপমুখ্যমন্ত্রীর কমরেডদের দ্বারা মহাকরণের অলিন্দে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। সুতরাং হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে টালির ছাদের বাড়িতে থেকে, আটপৌরে শাড়ি ও হাওয়াই চপ্পল পরে যদি কেউ রাজ্য শাসনের দায়িত্বে থাকেন, তাঁকে সহ্য করা অনেকেরই একটু মুশকিল হয়ে পড়ে। বিশেষত, যাঁরা নিজেদের বুদ্ধিজীবী এবং অভিজাত হিসেবে দাবি করেন।
প্রশাসনে বহু-আলোচিত একটি কথা আছেট্যাক্টফুল। বাংলা করলে দাঁড়ায় কৌশলী। কী রকম? কম কথা বলতে হবে। অর্থাৎ, বাক্য শেষ করা চলবে না। যা করা হবে তার উলটো বলতে হবে এবং যা বলা হবে তার উলটো করতে হবে। কোনও ঘটনা ঘটলে অধস্তনের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে নিজের কুর্সি বাঁচাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী কখনও জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখবেন না। মহাকরণ থেকেই তিনি ছড়ি ঘোরাবেন। মন্ত্রী, আমলারা যা বলবেন তাতেই ঘাড় নাড়বেন এবং তাঁদের নির্দেশ মতোই নথিতে একটি মহামূল্যবান সই করবেন। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এই নিয়মের ঘোর ব্যতিক্রম।
বামফ্রন্টের আমলে কো-অর্ডিনেশন কমিটির এক মাতব্বর রাজ্য যোজনা পর্ষদের যুগ্ম সচিবকে তাঁর অফিসের মধ্যে চরম অপমান করলেন। নথিতে তাঁর শাস্তির সুপারিশ হল। মন্ত্রী বিভাগীয় সচিবকে ডেকে বললেন, ‘কী রকম আপনার যুগ্ম সচিব? এক জন প্রধান সহায়ককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না?’ এই বলে সই না-করে নথি ফেরত দিয়ে দিলেন। মহাকরণের চিত্রটা কিন্তু বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অনেকটা বদলে দিয়েছেন। কর্মচারীদের মধ্যে সেই বেপরোয়া ভাবটা নেই। কিছুটা ভয়ভীতি এসেছে। নিকট অতীতে ধর্মঘটের দিন কর্মচারীদের উপস্থিতির হার দেখেই সেটা বোঝা যায়। দাবি আদায়ের নামে আধিকারিকদের টেবিল চাপড়ে স্লোগান দেওয়ার খবর আর পাই না। কর্মসংস্কৃতির আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এ রকম দাবি না-করলেও অবস্থার যে গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে, সেটা অবশ্যই বলা যায়। এত খুঁটিনাটি ডিটেলে কোন মুখ্যমন্ত্রী গেছেন?
অতীতে কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে উন্নয়নের কাজকর্ম তদারকি ও মূল্যায়নের জন্য এত জেলাসফর করতে দেখা গেছে কি? এ জন্য আমলা এবং মন্ত্রী সবাই সতর্ক এবং তটস্থ। পর্যালোচনার মিটিংয়ে তিনি কাউকেই রেয়াত করেন না। সে তিনি জাঁদরেল আমলাই হোন বা বরিষ্ঠ মন্ত্রী।
দেবকীনন্দন মণ্ডল। কলকাতা-৯১ |