প্লাবন, সুনামি, সংঘাত, এবং উন্নয়ন। দেশের মধ্যেই যাঁরা নানা কারণে ছিন্নমূল হয়ে চলেছেন
তাঁদের সম্পর্কে মূল্যবান কাজ করে চলেছেন ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন
শিবাজীপ্রতিম বসু |
উন্নয়ন তো সবাই চায়, কিন্তু তার মূল্য কে চোকায়?— নানা কথার মাঝে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ। দীর্ঘদেহী পঁচাত্তর বছরের এক তরুণ গবেষক। আদতে কর্নাটকের লোক, কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে আছেন গুয়াহাটিতে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমাজ গবেষণা কেন্দ্রের (এনইএসআরসি) অধিকর্তা। ভারতের নানা প্রান্তে, বিভিন্ন কারণে অভ্যন্তরীণ ডিসপ্লেসমেন্ট বা বিস্থাপনের যে-ঘটনা ভয়াবহ ভাবে বেড়ে চলেছে, তার নিরলস ও নির্ভরযোগ্য গবেষক। এমনকী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ অবধি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত ‘জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পুনঃসংস্থাপন’ বিল নিয়ে নানা আলোচনায় ওয়াল্টারের দেওয়া তথ্যকে প্রামাণ্য গণ্য করেছেন। সে হিসেবও অবশ্য বছর দশেকের পুরনো, স্বাধীনতার পর থেকে প্রথম পাঁচ দশকের। ওয়াল্টার জানিয়েছেন, এই সময়কালে ভারতে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিস্থাপিতের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ কোটি। গত এক দশকে হু-হু ভরবেগে এই সংখ্যা আরও এক কোটি বেড়ে ছ’কোটিতে পৌঁছেছে!
চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। একটু আগেই ‘উন্নয়ন ও বিস্থাপন’ বিষয়ে একটি প্যানেলে ওয়াল্টার তাঁর কথা শুনিয়েছেন। বাংলার অনুরাধা তলোয়ার আর শ্রীলঙ্কার জেহান পেরেরাও একই প্যানেলে ছিলেন। মাঝে একটু বিরতি। চার পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নানা বর্ণের বহু মানুষ। ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া-সহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে ‘বলপূর্বক বিস্থাপন’ নিয়ে ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (আইএএসএফএম) যোগ দিতে এসেছেন। দেশে দেশে, ভিতরে ও বাইরে ক্রমশ বাড়তে থাকা বিস্থাপনের বিচিত্র স্বরূপ বুঝতে, বিস্থাপিত-সহ সমাজের নানা অংশের প্রান্তিক মানুষদের (যাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা প্রচুর) সমস্যা, অধিকার ও ন্যায়ের বিষয়ে মতবিনিময়ের জন্য গবেষক, কর্মী ও ক্ষতিগ্রস্তদের এই সম্মেলন। |
নিজের দেশেই ঘরবাড়ি-জীবিকা-চেনা পরিবেশ-সংস্কৃতি ছাড়তে বাধ্য হয়ে অন্যত্র দিনাতিপাত করার দুঃসহ স্মৃতি হয়তো আগেও ছিল। কিন্তু পাঁচ দশকে তার চেহারা, পদ্ধতি বা পরিমাণ জটিল ও বিপুল হয়েছে। এতটাই যে, রাষ্ট্রপুঞ্জ এখন এই ঘরছাড়াদের ‘অভ্যন্তরীণ বিস্থাপিত ব্যক্তি’ ‘ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পারসনস’ বা ‘আইডিপি’ বলে পৃথক পর্যায়ভুক্ত করেছে। ১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদ এদের সুরক্ষা, পুনর্বাসন ও জীবিকা-সহ নানা অধিকার সুনিশ্চিত করতে কিছু মার্গদর্শক নীতি প্রণয়ন করে, যাতে এই নীতিগুচ্ছ অনুসরণ করে রাষ্ট্রগুলি আইডিপি-দের বিষয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে।
ভারত এখনও এই নীতিগুচ্ছ গ্রহণ করেনি, এমনকী সরকারি ভাবে ‘আইডিপি’ শব্দটিও মেনে নেয়নি। তার আশঙ্কা, এই সূত্র দিয়েই ভবিষ্যতে আইডিপি-দের ‘মানবিক সহায়তা’ দেওয়ার নাম করে, বহু বিদেশি (পড়ুন, পশ্চিমি) রাষ্ট্র ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ হস্তক্ষেপ করতে পারে। আজ বলে নয়
অথচ, ওয়াল্টার জানালেন, অভ্যন্তরীণ বিস্থাপন অবশ্য কেবল উন্নয়নের কারণেই ঘটে না, গোষ্ঠী-দাঙ্গা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা স্রেফ খেয়েপরে বাঁচতে চাওয়ার কারণেও লোক ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। সীমান্ত অঞ্চলে সামরিক সংঘর্ষ (যেমন, ভারতে জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্ত সংলগ্ন নানা স্থানে), বা রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সংঘর্ষের ফলেও (যেমন, মধ্য ভারত ও নেপালে পুলিশ/মিলিটারি বনাম মাওবাদীদের লড়াইয়ে) দেশের মধ্যেই ঘরছাড়াদের দল বাড়তে থাকে। এর মধ্যে কাশ্মীর ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ধারাবাহিক সংঘর্ষের ইতিহাস আছে। ফলে, সংঘর্ষ-প্রভাবিত আইডিপি-দের সংখ্যাও এখানে লাগামছাড়া। এই সব কিছুর মধ্যে উন্নয়নজনিত বিস্থাপন এক নতুন ও মারাত্মক মাত্রা যোগ করেছে, যার সঠিক মোকাবিলা না করলে আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়তে পারে। ওয়াল্টারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিস্থাপিতদের মধ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ আদিবাসী, ২০ শতাংশ দলিত, ১০ শতাংশ দুর্বলতম অনগ্রসর। অর্থাৎ, ৭০-৮০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ যাঁদের অধিকাংশেরই প্রতিবাদের আধুনিক ভাষা রপ্ত হয়নি, তাই নীরব/নিশ্চুপ, তাঁদের ওপরেই উন্নয়নী বিস্থাপনের কুঠার নামছে সবচেয়ে বেশি।
ওয়াল্টারের সঙ্গে আলাপের মাঝে আড্ডায় জড়ালেন কে এম পারিভেলান, মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর ‘বিপর্যয়’-বিষয়ক গবেষক। তিনি শোনালেন, সুনামি-পরবর্তী উপকূলবর্তী অন্ধ্র ও তামিলনাড়ুতে মৎস্যজীবীদের বিস্থাপনের নতুন কাহিনি। এই সব উপকূল-অঞ্চলে সুনামির আগে থেকেই বন্দর-নির্মাণ ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের কথা চলছিল, সুবিধা হচ্ছিল না, ওই স্থানগুলিতে বিপুল পরিমাণে জেলেদের বসতি হওয়ায়। সুনামির পরে, ‘নিরাপত্তার’ কারণে তাঁদের অনেককে উপকূল থেকে ৫ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে, এর ফলে তাঁদের যাতায়াতের দৈনিক খরচ অনেক বেড়ে গেছে যদিও কিছু দিনের মধ্যেই ওই মৎস্যজীবীর দল সবিস্ময় দেখলেন, তাঁদের ফেলে আসা জমিতে পূর্বে পরিকল্পিত বাণিজ্যিক বন্দর, ‘থিম পার্ক’ প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে। বিস্থাপন-বিষয়ে সরকারের সঠিক তথ্য ও নীতি না থাকার কুফল সম্পর্কে অন্য একটি অভিজ্ঞতা জানালেন পারিভেলান। সুনামির পরে আন্দামান/নিকোবরে সরকারি উদ্যোগে হেলিকপ্টার থেকে কম্বল ফেলা হয়েছিল। যাঁরা এই মহান কাজ করেছিলেন, তাঁরা জানতেনই না, বছরের কোনও সময়েই ওই অঞ্চলে কম্বল লাগে না!...
অনিবার্য ভাবে মনে পড়ে যায় সিঙ্গুর-প্রসঙ্গ। জিজ্ঞাসা করি, সিঙ্গুরে কোনটা ঠিক ছিল— সরকারের জমি অধিগ্রহণ, না বাজারের হাতে পুরোটা ছেড়ে দেওয়া? কোনওটাই নয়, বললেন ওয়াল্টার। জনহিতকর কাজ ছাড়া ব্যবসায়িক প্রয়োজনে সরকার জমি অধিগ্রহণের মতো জটিল ও গোলমেলে বিষয়ে জড়াবে কেন? কিন্তু তা বলে খোলা বাজারের হাতে সবটা ছেড়ে দেওয়া মানেও তো কিছু হিংস্র জমি-মাফিয়ার হাতে চাষিদের ছেড়ে দেওয়া। তাই, জমি কেনাবেচার ওপরে সরকারের কড়া নজর ও নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে, যেমনটা বেসরকারি শিল্পের ক্ষেত্রে সরকার করে, নইলে সমূহ সর্বনাশ।
|