শীত আসিয়াছে। মেলা বসিয়াছে। কেবল মিলন-মেলা নহে, ধর্ম-মেলাও। স্বাভাবিক, অনিবার্য। ইন্ডিয়ার ভিতরে ভারত, ভারতের নানা টানাপড়েন লইয়াই ইন্ডিয়া। সুদূর উত্তরপ্রদেশের কেহ গঙ্গাসাগরে আসিতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গের কেহ যাইতে পারেন কুম্ভে। একা বা সদল। গ্রামান্তরের মানুষ মেলায় গিয়া কোন পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হইতেছেন, বা পূর্ণতা লাভই তাঁহাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি না, এই সকল কূট প্রশ্ন ভারতের বহু কৌমের বহু মানুষের যাত্রাকে তুচ্ছ করিতে চাওয়া কেবল অগণতান্ত্রিক নহে, অবুদ্ধির পরিচায়কও। পৃথিবীর এই বহুত্বময় বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভূমিতে কী ভাবে বৃহৎ ধর্মমেলাকে সুষ্ঠু সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনা প্রদান করা যায়, প্রশাসনিক ভাবে বরং এই চ্যালেঞ্জকেই গ্রহণ করিতে হইবে। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, অতীতে যে অবস্থা ছিল এখন তাহার চাহিতে অবস্থার উন্নতি হইয়াছে। মেলা স্থলে নিরাপত্তা রক্ষা, রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, বর্জ্য পদার্থের নিষ্কাশন ইত্যাদি আগের চাহিতে ভাল ভাবে হয়। মেলাপ্রাঙ্গণে জমায়েত মানুষ সদল কোনও সংক্রামক রোগের শিকার হইতেছেন, এমন খবরও ইদানীং কম। আগে এই জাতীয় মেলায় যে ভাবে দলে দলে মানুষ উদর-সংক্রান্ত রোগে ভুগিতেন এখন আর তেমন শোনা যায় না। এ সবই ভাল, কিন্তু যথেষ্ট নহে।
এই সকল মেলার আয়োজন তো কেবল নির্দিষ্ট প্রাঙ্গণে আটকাইয়া থাকে না। বরং মেলার মরসুম পড়িলেই জনস্রোতের চলাচল শুরু হইয়া যায়। এক স্থান থেকে অপর স্থানে যাতায়াতের পথে মেলার ভিড় আর নিত্যযাত্রীদের ভিড় মিলিয়া মিশিয়া একাকার হইয়া যায়। নিত্যযাত্রীরা তখন এই মেলার মানুষদের সন্দেহ, বিরক্তি, করুণার চোখে দেখেন। ইহারা যেন মূর্তিমান উপদ্রব। এখানেই যেন ভারত ও ইন্ডিয়ার মধ্যে ব্যবধান ও দূরত্ব গড়িয়া উঠে। নিত্যযাত্রায় নানা কর্মে যাওয়া শহুরে ইন্ডিয়া হাওড়া স্টেশনে বা বাবুঘাটে মেলাগামী ভারতীয় জনগণকে কিছুতেই নিজেদের সহিত মিলাইতে পারেন না। ইহা সত্যই বেদনার। এখানেই প্রশাসনের বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। প্রশাসন তৎপর হইলে এবং যাত্রাপথের এই ভিড়কে সুষ্ঠু ভাবে নিয়ন্ত্রণ করিলে নিত্যযাত্রীরা আর ইহাদের হীন চক্ষে দেখিত না। বরং এই ভারতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হইত। নিজের দেশের শহুরে চেহারার বাহিরেও যে নানা চেহারা আছে, মেলাগামীদের দেখিয়া বিরক্ত না হইয়া তাহা বুঝিবার চেষ্টা করিত।
তবে সে সব অনেক বড় প্রশ্ন। সমাজের মন পরিবর্তনের প্রশ্ন। তাহা এক দিনে হইবার নহে। কিন্তু মন পালটাক বা না পালটাক, আপাতত স্বাস্থ্যকর পরিচ্ছন্নতা ও যাতায়াতের সুগমতা বজায় রাখিতে পারিলেই অনেকটা কাজ হইবে। প্রশাসনের উচিত, কেবল মেলা-প্রাঙ্গণে নহে, যাতায়াতের পথেও এই দুইটি বিষয়ে নজর রাখা। ভারত ও ইন্ডিয়ার এই সামীপ্যই আধুনিক মেলার দর্শন হইতে পারে, এই সামীপ্য যাহাতে গড়িয়া উঠে তাহা দেখাই প্রশাসনের কাজ। |