আর পাঁচটা দিনের মতোই স্কুলে এসেছিল বছর এগারোর হাসিখুশি ছেলেটি। টিফিনের আগে পর্যন্ত রোজকার মতোই ক্লাস করেছে, হাসি-মজা-খুনসুটিতে মেতেছে বন্ধুদের সঙ্গে। তখনও পর্যন্ত কারও কল্পনাতেও আসেনি, আর মাত্র মিনিট দশেক পরেই তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে এমন ভয়ঙ্কর পরিণতি।
স্কুলের মাঠে টিফিন খেতে খেতে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিল নিউ টাউন দিল্লি পাবলিক স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আরিয়ান দত্ত। আচমকাই তার গলায় খাবার আটকে যায়। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। খবর পেয়ে মাঠে পৌঁছে যান অধ্যক্ষা-সহ অন্য শিক্ষিকারা। স্কুলের ক্লিনিকের নার্সরা তার গলা থেকে কিছুটা খাবারও বার করে ফেলেন। কিন্তু দ্রুত অবস্থার অবনতি হতে থাকে ওই পড়ুয়ার। শিক্ষিকারাই স্কুলের গাড়িতে তাকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেন সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, দিনভর অত্যন্ত সঙ্কটজনক অবস্থায় ছিল আরিয়ান। ভেন্টিলেশনে রাখতে হয় তাকে। রাত সাড়ে আটটায় সব লড়াই শেষ হয়ে যায়। মারা যায় আরিয়ান।
স্কুলের অধ্যক্ষা সোনালি সেন জানান, টিফিনের সময়ে তাঁর ঘরে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে তাঁর মিটিং চলছিল। |
হাসপাতালে উদ্বিগ্ন পরিজনেরা। মঙ্গলবার বিকেলে। —নিজস্ব চিত্র |
বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ সেখানেই নিরাপত্তাকর্মীদের মারফত আরিয়ানের অসুস্থতার খবর পান তাঁরা। তৎক্ষণাৎ স্কুলের মাঠে যেখানে বসে আরিয়ান টিফিন খাচ্ছিল, সেখানে চলে যান তাঁরা। সোনালিদেবী বলেন, “আমাদের স্কুলে সব সময়েই প্রশিক্ষিত নার্স থাকেন। তাঁরাই ওর মুখের ভিতর থেকে বিস্কুট বার করেন। দেখি, ছেলেটির শরীর শক্ত হয়ে গিয়েছে। ওর শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকায় সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে মজুত করা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসা হয়। তার পরে স্কুলের গাড়িতেই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।” অ্যাম্বুল্যান্স ডাকা হল না কেন? সোনালিদেবীর দাবি, “অ্যাম্বুল্যান্স ডাকলে দেরি হয়ে যেতে পারত। তাই দ্রুত স্কুলের গাড়িতেই ওকে তোলা হয়। আমাদের বড় গাড়িতে ওকে অক্সিজেন দিতে দিতেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে আমরা হাসপাতালে পৌঁছে যাই।”
হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “খুবই সঙ্কটজনক অবস্থায় আনা হয় ছেলেটিকে। চোখের মণি ঘোলাটে ছিল। রক্তচাপ খুবই নেমে গিয়েছিল। নাড়ির গতিও ছিল অস্বাভাবিক কম। পাম্প করে পেট থেকে খাবার মেলে। সব রকমের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ছেলেটিকে বাঁচানো গেল না।”
কী ভাবে এমন ঘটতে পারে? চিকিৎসকদের বক্তব্য, তাড়াহুড়ো করে খাওয়ার সময়ে বা খেতে খেতে কথা বললে অনেক সময়েই খাবার শ্বাসনালীতে আটকে যাওয়ার ভয় থাকে। কখনও কখনও তার পরিণতি হয় মারাত্মক। এমনকী, ফুসফুসে খাবার আটকে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। আরিয়ানের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে বলে তাঁদের আশঙ্কা। শিশু-রোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, “এ ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা শুরু হওয়াটা সব থেকে জরুরি। ১০ মিনিট বা তার বেশি অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ থাকলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে। এই কারণেই খাওয়ার সময়ে তাড়াহুড়ো করা বা কথা বলতে বারণ করা হয়।”
এ দিন দুপুরে স্কুল থেকেই খবর দেওয়া হয় মানিকতলা ডাফ রোডে আরিয়ানের বাড়িতে। পরিবারের লোকজন ছুটে যান হাসপাতালে। আরিয়ানের বাবা পলক দত্ত একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের আধিকারিক। তাঁর দুই ছেলে। আরিয়ানই বড়। বিকেলে আরিয়ানের দাদু শিবপ্রসাদ দে বলেন, “দুপুরে স্কুল থেকে খবর দেওয়া হয়। বলা হয়, দ্রুত নার্সিংহোমে যেতে। এসে দেখি ও আইসিইউ-তে।”
বিকেলে হাসপাতালে আরিয়ানকে দেখতে এসেছিল সহপাঠী সোহম দে। সে বলে, “আরিয়ান খুব হাসিখুশি। আমার খুব ভাল বন্ধু। ও সব সময়ে মজার মজার কথা বলে। টিফিনের সময়ে আমি ক্লাসে বসে অন্যদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। তখনই শুনি, গলায় খাবার আটকে ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে ওকে দেখতে এসেছি।” বন্ধুর সঙ্গে অবশ্য দেখা হয়নি সোহমের। ভেন্টিলেশনে তখন জীবনযুদ্ধে লড়ছে আরিয়ান।
রাতে স্কুলের অধ্যক্ষা সোনালিদেবী বললেন, “আমার ছেলেকেই হারালাম। অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও কিছু করা গেল না।” |