সবার আগে রাজনীতি। বাদবাকি সব পিছনের সারিতে। পশ্চিমবঙ্গের এই ভাবমূর্তি বদলে দেওয়ার আশা জাগাতে পারছে না কলকাতা বিমানবন্দরের ঝাঁ চকচকে নয়া টার্মিনালও। উদ্বোধনের আগেই তার গর্ব ফিকে হয়ে যাওয়ার জোগাড় রাজনীতির কাজিয়ায়।
আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল তৈরি হয়েছে কলকাতা বিমানবন্দরে। উদ্বোধন ২০ জানুয়ারি। তার অনেক আগে থেকেই একের পর এক বিদেশি বিমানসংস্থাকে কলকাতায় নিয়ে আসার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। সকলেরই আশা, নতুন টার্মিনাল যেমন শহরের সৌন্দর্য বাড়াবে, পাশাপাশি বদল আনবে এ শহরের তথা রাজ্যের ভাবমূর্তিতেও। কিন্তু, রাজনীতির দায় তা মানলে তো!
টার্মিনাল উদ্বোধনের ৯ দিন পরই কর্মী ইউনিয়নের নির্বাচন। বিমানবন্দরের রাস্তায় ফ্লেক্স-ব্যানার-পোস্টার। পোস্টার পড়েছে বর্তমান দুই টার্মিনালের ভিতরেও। ভোটার সংখ্যা দেড় হাজারেরও কম। তাঁদের ঘিরেই এক দিকে বাম-সমর্থিত ইউনিয়নের ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই। অন্য দিকে, তৃণমূলের ক্ষমতা দখলের আকাঙ্ক্ষা। দু’পক্ষের বিরোধ মাঝেমধ্যেই এমন মারমুখী হয়ে উঠছে যে ছুটতে হচ্ছে পুলিশকে। এখন যখন নতুন টার্মিনালের উদ্বোধন নিয়ে সকলের চরম ব্যস্ত থাকার কথা, তখন নির্বাচন নিয়ে অতি-গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডাকতে বাধ্য হচ্ছেন কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ, নির্বাচনের দিন বাইরে থেকে প্রচুর লোক-লস্কর আনা হবে। মঙ্গলবারও এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। অল্পসংখ্যক ভোটারের জন্য দু’টি বুথই যথেষ্ট। কিন্তু, দু’পক্ষই চায় বুথ হোক আরও বেশি। বিমানবন্দরের পথে কাচে মোড়া নতুন যে প্রশাসনিক ভবন তৈরি হয়েছে, ঠিক হয়েছে নির্বাচন হবে সেখানে। সাধারণ নির্বাচনের নিয়ম মেনে সে দিন বুথের ২০০ গজের মধ্যে কোনও দলীয় কার্যালয় রাখা হবে না। কিন্তু ভোটের বুথ বাড়িটির ভিতরে হবে না বাইরে, তা নিয়েও সংশয় ও বিরোধিতা তৈরি হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে বাইরে থেকে ফোর্স চেয়ে পাঠাতে হবে। |
গণ্ডগোলের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, গত ২০ অক্টোবরই তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। সে দিন কর্তৃপক্ষের সমবার সমিতির ভোট গোনার কাজও তিন রাউন্ডের পরে থেমে যায় গণ্ডগোলের জেরে। সেই ব্যালট বাক্স আজও থানায় জমা পড়ে রয়েছে। তাই ২৯ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে বিমানবন্দরের অধিকর্তা বি পি শর্মার প্রতিক্রিয়া, “চিন্তায় রয়েছি। এর বেশি কিছু বলব না।”
পাঁচ বছর অন্তর কর্মী ইউনিয়নের এই নির্বাচন হয়। ২০০৮-এ জিতেছিল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (এএইইউ)। বাম-ঘেঁষা এই ইউনিয়নই বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে পথে নেমে স্তব্ধ করে দিয়েছিল কলকাতা বিমানবন্দর। এত দিন বিমানবন্দরে একচেটিয়া দাপট ছিল তাদের। আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কামগর ইউনিয়ন। কংগ্রেস তাদের সমর্থন করলেও, কলকাতায় কামগর বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি।
মহাকরণে পালাবদলের পরে বদলে গিয়েছে ছবিটা। তৃণমূল এখন বিমানবন্দরের দখল চায়। কিন্তু, তাদের স্টাফ অ্যান্ড এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন মাত্র এক বছর হল রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে। ফলে, কর্তৃপক্ষের নিয়ম মতো সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না তারা। কিন্তু, বাম-ঘেঁষা ইউনিয়নকে সরাতে তারা মরিয়া। যে কারণে কংগ্রেস-তৃণমূল বাইরে যতই একে অপরকে আক্রমণ করুক না কেন, বিমানবন্দরে তারা একজোট। এবং এই জোট এতটাই মজবুত যে, কংগ্রেস ইউনিয়নের প্রতিনিধি হয়েই কর্তৃপক্ষের ডাকা বৈঠকে হাজির থাকছেন তৃণমূলের নেতা!
দু’দলের তাবড় নেতারাও সমর্থন করেছেন জোটকে। কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “কর্মী ইউনিয়নের ক্ষেত্রে এ রকম সমঝোতা হয়েই থাকে।” সৌগত রায় বলেছেন, “দীর্ঘদিন বামেদের দখলে ছিল। আগে তো তাদের সরাই। জোট নীতিহীন কি না পরে ভেবে দেখা যাবে।” ইউনিয়ন দখলের এই ধুন্ধুমার লড়াইয়ের কাছে নয়া টার্মিনালের ঔজ্জ্বল্যও যেন ফিকে। এ রাজ্যে যেমন হয়ে থাকে! |