দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ টানার জন্য প্রতি বছর বিপুল খরচ করে সম্মেলনের আয়োজন করে কেন্দ্রীয় সরকার। অধিকাংশ বড় রাজ্যই তাতে যোগ দেয়। কিন্তু ‘বেঙ্গল লিডস’-এর কারণ দেখিয়ে পর পর দু’বার তা এড়িয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ!
কেন্দ্রের ওভারসিজ ইন্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্স (ওআইএ) মন্ত্রক বিভিন্ন রাজ্যে ‘প্রবাসী ভারতীয় দিবস’ সম্মেলন করার জন্য সব খরচ বহন করে। প্রতি বছর ৯ জানুয়ারি এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গত বছর রাজস্থানের জয়পুরে হয় এই সম্মেলন। এ বছর হল কেরলের কোচিতে। মূলত বিদেশে বসবাসরত ভারতীয় শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সরাসরি বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই ২০০৪ থেকে প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনাবাসীদের পাশাপাশি দেশের একাধিক বড় শিল্পসংস্থাও যোগ দেয় এই সম্মেলনে। কিন্তু শিল্প নিয়ে সরকারি স্তরে প্রচুর উদ্যোগের কথা বললেও পশ্চিমবঙ্গ অধিকাংশ সময়েই এই সম্মেলনে যোগ দেয়নি।
এ বারেও তার অন্যথা হল না। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এখানে ‘বেঙ্গল লিডস’ তো করছিই।” কিন্তু কেন্দ্রের শিল্প সম্মেলনে যোগ দিতে আপত্তি কোথায়? পার্থবাবু বলেন, “জানি, ওখানে যোগ দিলে ভালই হতো হয়তো। পরের বার দেখা যাক।” যদিও গুজরাতে এই জানুয়ারিতেই রাজ্য স্তরে শিল্প সম্মেলনের (‘ভাইব্রান্ট গুজরাত’) আয়োজন করা হলেও কোচিতে সরকারের বরিষ্ঠ সচিবদের পাঠাতে ভোলেনি নরেন্দ্র মোদীর সরকার। গত বছর রাজস্থানেও সরকারের পদস্থ কর্তাদের জয়পুরের সম্মেলনে পাঠিয়েছিলেন মোদী।
রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত জানিয়েছিলেন, ওই সম্মেলনে তাঁর সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি শিল্প সংস্থার ৯৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি (‘মউ’) স্বাক্ষরিত হয়েছে। তার মধ্যে একটা বিরাট অংশ ছিল পর্যটন শিল্প সংক্রান্ত লগ্নির চুক্তি। পাশের রাজ্য গুজরাতের নরেন্দ্র মোদী থেকে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডি অনেকের প্রতিনিধিই ছুটে গিয়েছিলেন জয়পুরে। ব্যতিক্রম শুধু পশ্চিমবঙ্গ।
এই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য ওআইএ মন্ত্রক থেকে প্রতি বারই সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে চিঠি পাঠানো হয়। সেই হিসেবে পশ্চিমবঙ্গেও চিঠি আসার কথা। এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে রাজ্যের শিল্প দফতরের নতুন সচিব চঞ্চলমল বাচওয়াত বলেন, “আমি সবে এই দফতরে যোগ দিয়েছি। এ রকম কোনও আমন্ত্রণ এসেছিল কি না, বলতে পারব না।”
এই সম্মেলনের আয়োজন করার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রকে প্রস্তাব পাঠায় রাজ্যগুলি। এ রাজ্য থেকে এক বারও দিল্লিতে সে রকম প্রস্তাব যায়নি। না বাম জমানায়, না পরিবর্তনের যুগে।
অথচ, ২০১১র মে মাসে রাজ্যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন সরকার লগ্নি আনার জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা শুরু করেন শিল্পপতিদের সঙ্গে। সিঙ্গুর-পর্বের পরিচিতি থেকে নিজেদের মুক্ত করে শিল্পমুখী পরিচয় গড়ে তোলার ঘোষণাও হয়। কিন্তু রাজ্য প্রশাসন যে কোনও সুযোগই গ্রহণ করতে রাজি নয়, এ বার কোচির সম্মেলনেও না-যাওয়ায় তা আবার প্রমাণ হল।
গত বছর কী করেছিল রাজ্য সরকার?
বর্তমানে রাজস্থানের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের সচিব পুরুষোত্তম অগ্রবাল গত বছর জানুয়ারিতে জয়পুরে আয়োজিত প্রবাসী ভারতীয় দিবস অনুষ্ঠানের মুখ্য আয়োজকের দায়িত্বে ছিলেন। জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এই আইএএস অফিসার এত দিন ছিলেন রাজস্থানের বিনিয়োগ, অনাবাসী বিষয়ক দফতরের (এমন কোনও দফতর পশ্চিমবঙ্গে নেই) সচিব। এ দিন তিনি জয়পুর থেকে টেলিফোনে বলেন, “গত বছর আমি চেয়েছিলাম, সারা পৃথিবী থেকে আগত অনাবাসী এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পপতিদের সামনে আমার জন্মস্থানের রাজ্য যতটা সম্ভব সুযোগ তুলে নিক। কিন্তু কলকাতা থেকে এক জন সরকারি লোককেও পাঠানো হয়নি! দেশি-বিদেশি শিল্পপতিদের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনার জন্য পশ্চিমবঙ্গের নাম আমন্ত্রক রাজ্য রাজস্থানের পরেই রেখেছিলাম। কিন্তু কলকাতা সাড়া দেয়নি।”
পুরুষোত্তমবাবু আরও বলেন, “আমি চেয়েছিলাম কলকাতা থেকে অন্তত পর্যটনের খোঁজখবর দেওয়ার জন্যও পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটা স্টল দিক। সে চিঠিরও কোনও উত্তর আসেনি এখানে!”ওই সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ যোগ না-দেওয়ায় আলোচনা-তালিকার দ্বিতীয় স্থানে তুলে আনা হয় ঝাড়খণ্ডকে। এর অন্যতম ফলশ্রুতি, উত্তর ভারতের সর্ব বৃহৎ সিমেন্ট শিল্প সংস্থা ১১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করছে ঝাড়খণ্ডে। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর কলকাতায়। |