পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি দেখে সিপিএম পলিটব্যুরোর সিদ্ধান্ত, শিল্পায়ন ও উন্নয়নের বিষয়কে আবার প্রচারের প্রধান হাতিয়ার করে তোলা হোক। আর প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি থেকে বিমান বসু সকলেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সেই প্রচারের প্রধান মুখ করতে চাইছেন।
সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিপথগামী অগ্রাধিকার দেখে মাত্র দেড় বছরেই গোটা রাজ্যের মানুষ ক্রমশ অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ছেন। আজ হলদিয়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’-এর ছবি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, দেশের অধিকাংশ বিশিষ্ট শিল্পপতির গন্তব্যস্থল পশ্চিমবঙ্গ নয়। এই পরিস্থিতিতে মমতার সরকারের শিল্পায়নের বিপরীতে হাঁটার (ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন) সমালোচনা করে বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের পাল্টা স্লোগান তুলতে চাইছে সিপিএম। তবে দলীয় নেতৃত্ব এটাও বুঝতে পারছেন যে, তৃণমূল সরকার সম্পর্কে মানুষের মোহভঙ্গের প্রক্রিয়া শুরু হলেও তাঁরা কিন্তু এখনও বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পাননি।
কলকাতায় পরশু থেকে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির তিন দিনের বৈঠক। এই বৈঠকে ঠিক কী ভাবে শিল্পায়নের বিষয়টিকে সামনে রেখে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে, তার রূপরেখা তৈরি করা হবে। আন্দোলনের পথ নিয়ে অবশ্য সিপিএমের মধ্যে বিরোধ কম নয়। উন্নয়নের ডাক দিতে চাইলেও ২০-২১ ফেব্রুয়ারি সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা সাধারণ ধর্মঘটে সামিল হতে চলেছে তারা। এই আন্দোলন মূলত মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে হলেও পশ্চিমবঙ্গে ওই দু’দিন কী অবস্থান নেওয়া হবে, সেটা মস্ত বড় বিতর্কের বিষয়।
কথায় কথায় হরতাল ও ধর্মঘটের সমালোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল যে বন্ধের রাজনীতি থেকে সরে এসেছে, সেটা স্বীকার করছেন সিপিএমের রাজ্য নেতাদের অনেকেই। বিরোধী দল হিসেবে তৃণমূল যখন বন্ধ, অবরোধ করত, তখন বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, “আমাদের পরিত্যক্ত পথে ওরা হাঁটছে।” আর আজ নিজেরা বিরোধী আসনে গিয়ে সিপিএম ফের সেই পথেই হাঁটবে কিনা, সেটাই প্রশ্ন।
প্রশ্ন, পাল্টা আক্রমণের রাস্তায় হেঁটে জেলায় জেলায় হারানো জমি সিপিএম ফিরে পেতে পারে কিনা, সেটাও। ভাঙড়ে রেজ্জাক মোল্লা আক্রান্ত হওয়ার পরে দলীয় কর্মীরা যে ভাবে উজ্জীবিত হয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন, তাতে এই বিষয়টি বিশেষ করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। প্রতিরোধের মধ্যেই ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন সিপিএমের অনেকে।
রেজ্জাকের উপরে আক্রমণ ঘিরে প্রতিবাদ বুদ্ধবাবুকেও ফের সামনে নিয়ে এসেছে। বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে দীর্ঘদিন গুটিয়ে রেখেছিলেন। আলিমুদ্দিনের বাইরে তাঁকে প্রায় দেখাই যায়নি। কিন্তু ভাঙড়-কাণ্ডের প্রতিবাদে ফের তিনি রাস্তায় নেমেছেন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একাধিক জনসভা করেছেন। এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে হাসপাতালে গিয়ে আহত রেজ্জাকের সঙ্গে দেখা করে ঐক্যের
বার্তা দিয়ে এসেছেন। এই রেজ্জাকই মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর শিল্পনীতির অন্যতম সমালোচক ছিলেন। বিধানসভা ভোটে হারের পর বুদ্ধবাবু এবং তাঁর শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে দায়ী করে বিস্তর কড়া কথা বলেছিলেন তিনি।
রেজ্জাকের সুরেই বুদ্ধবাবুর শিল্পনীতির সমালোচনা করে দলের অনেকেই বলেছিলেন, কৃষিজমি এবং কৃষকদের স্বার্থরক্ষাকে অনেক বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। কারণ, কৃষি আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই সিপিএমের উত্থান। গ্রামের গরিব চাষিরাই ছিল দলের সব থেকে বড় ভোটব্যাঙ্ক। কেন্দ্রের নব্য উদারবাদী অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত হওয়া মানে দলের গণভিত্তিকে অবক্ষয়ের পথে ঠেলে দেওয়া ভোট বিপর্যয়ের পর এটাই ছিল সিপিএমের একটা বড় অংশের অনুভব।
সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “বুদ্ধবাবু জেগে উঠেছেন। এটাই দলের কাছে সব থেকে বড় আশার কথা। আসলে বর্তমান পরিস্থিতি আবার প্রমাণ করছে যে, বুদ্ধবাবু ও নিরুপমবাবুর শিল্পনীতিতে কোনও ভুল ছিল না। সমস্যা হয়েছিল প্রয়োগে ও প্রশাসনিক ব্যর্থতায়।”
বস্তুত, কৃষি আর শিল্পের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার বার্তা দেওয়াই সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সামনে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এক দিকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে গ্রামের মানুষকে অভয় দিতে হবে। বোঝাতে হবে যে, কৃষকদের ক্ষতি হবে না, খাদ্যসঙ্কট দেখা দেবে না। আবার অন্য দিকে রাজ্যে ভারী শিল্প স্থাপনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলে তবেই যে বেকার সমস্যা দূর হতে পারে, সেটাও বোঝাতে হবে মানুষকে।
তৃণমূল সরকারের দাবি, তারা ছোট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষায় তৎপর। নিরুপমবাবু বলেন, “ছোট শিল্পের উপর জোর দেওয়াকে স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু ছোট ও বড় শিল্পের মধ্যে কোনও সংঘাত নেই। বরং একে অপরের পরিপূরক।”
সিপিএম সূত্র বলছে, পশ্চিমবঙ্গে অতীতে প্রধান তিনটি শিল্প ছিল গঙ্গার উপকূলে পাট, উত্তরবঙ্গে চা ও হাওড়া জেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং। পরে দুর্গাপুর ও আসানসোলে গড়ে ওঠে লৌহ ইস্পাত শিল্প। এই বড় শিল্পের কাঁচামাল জোগাতে ছোট ছোট কারখানাও গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে বড় কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছোট কারখানাগুলিও সমস্যায় পড়ে।
বুদ্ধবাবু ও নিরুপমবাবু মনে করেন, রাজ্যে বড় শিল্প গড়ে উঠলে ছোট শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রেরও বিস্তার ঘটবে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলেন, “ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার ইস্পাত কারখানার চেয়ে পরিষেবার ক্ষেত্রে বেশি সংস্কার করায় সে দেশে সমস্যা বেড়েছে। তখন ব্রিটেনে ৪ কোটি টন ইস্পাত উৎপাদন হতো, এখন হয় ৯০ লক্ষ টন।”
এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় কমিটি আলোচনায় দু’টি বিষয় উঠে আসতে চলেছে। প্রথমত, জেলায় জেলায় দলের সাবেক জনভিত্তি ধরে রাখতে রেজ্জাক মোল্লা, সুশান্ত ঘোষের মতো নেতাদের অচ্ছুত করা উচিত হবে না। দ্বিতীয়ত, শিল্পায়ন ও উন্নয়নই যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ বদলাতে পারে সেই বিষয়টিকেও প্রচারের অগ্রাধিকারে রাখতে হবে।উপকরণের গুণেই যেমন রান্নার বিচার হয়, তেমনি দ্বিমুখী এই রণকৌশলের মিশেলে সিপিএম উতরোতে পারে কিনা, তাই দেখার। |