|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়ো না |
অস্কারে টাকটা আঁচড়ে যাব |
তাঁর অভিনীত ‘সিলভার লাইনিং প্লে-বুক’ অস্কারে মনোনীত হয়েছে। কিন্তু এখনও অনুপম খের
মনে করেন অভিনেতা আর ছুতোরে তেমন পার্থক্য নেই। তাঁর কথা শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
|
মুখের পক্ষাঘাতের পরে আবার সিনেমায় ফেরত আসা। আর আজ এমন একটা সিনেমা করলেন যেটা অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছে! ফিরে তাকালে কেমন লাগে? আরে আমাদের জীবনটা আসলে সব সময় চমকে ভরা। যখন পিছনে ফিরে তাকাই, নিজেকে বলি, “চু**, কাহা থা অউর কাহা চলা আয়া।”
এ ভাবে নিজেকে বাহবা দেন? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বার বার সিমলায় নিজের বাড়ির ঠিকানাটা বলি। “৪/৪ নব হাউস সে বেভারলি হিলস তক। তেরি তো নিকল পড়ি!”
আর জীবনের ওঠাপড়ার ব্যাপারেও নিশ্চয়ই ভাবেন... হ্যা। জীবনে ওঠাপড়া থাকলে একটা বিশ্বাস জন্মায়। সেটা হল, যে কোনও কিছু ঘটতে পারে। অবশ্য এরকমও অনেক মুহূর্ত আছে যখন নিজের ওপরই নিজের করুণা হত। কিন্তু আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতাম।
এর রহস্যটা কী? মনে আছে যখন ‘স্ট্রাগলার’ ছিলাম, তখন প্রায়ই একটা ধাবাতে খেতে যেতাম। তখন কেউ চিনত না আমাকে। পরে যখন লোকে আমাকে চিনতে শুরু করল, তখনও আমার পকেট খালি। দেউলিয়া ছিলাম। ধাবার মালিক কিন্তু তখনও কোনও পয়সা নিতেন না আমার থেকে।
কারণ কী? ভালবাসা। শ্রদ্ধা। মুম্বইয়ের সেই ‘চওল’-টাতেও ফিরে গিয়েছিলাম প্রথম যেখানে আমি থাকতাম। ‘চওল’-টার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলেছিলাম, “যাই ঘটুক, আবার এই পরিস্থিতিতে আমাকে ফিরে আসতে হবে না।” মুম্বইতে যখন ‘স্ট্রাগলার’ হিসাবে আসি, পকেটে ছিল মাত্র ৩৭ টাকা। মনে আছে বাবা বলেছিলেন, “ভাল সময়ই হোক বা খারাপ সময়, কোনওটাই বেশি দিন স্থায়ী হয় না।”
আপনার বাবার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের দিন তো আপনাকে প্রচুর হাসিঠাট্টা করতেও দেখা গেছে...
হ্যা। সেই দিন তো আমি চুটকিও বলেছি! বাবার শেষ কথা ছিল, “লিভ লাইফ।” আসলে কাছের কেউ চলে যাওয়ার দুঃখ সারা জীবন থাকবেই। তবে সেটা বাইরের লোককে দেখানোর কী দরকার? বাবা নিজেও কোনও দিন চাইতেন না যে, ওঁর স্মরণসভায় এসে কেউ দুঃখ করুক। আমি এ ব্যাপারে আমার মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলাম। ওঁরাও রাজি হয়। এখন তো শুনছি এই ধরনের স্মরণসভা অনেক জায়গাতেই হচ্ছে।
আপনার বাবার কথার সূত্র ধরেই জিজ্ঞেস করি, ইন্ডাস্ট্রিতে কি কোনও স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু হয়? আমার তো মনে হয়, একমাত্র স্কুলের বন্ধুরা চিরকালের জন্য থাকে। তবে ইন্ডাস্ট্রিতেও কিছু ভাল বন্ধু ছিল আমার। যশ চোপড়া ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। অনিল কপূর আর এক জন। |
|
অনিল কপূরের সঙ্গেও তো মনোমালিন্য হয়েছিল!
আমাদের সম্পর্কটা এমনই যে মতবিরোধটা কী নিয়ে হয়েছিল সেটাই আজ আর মনে নেই! বর্তমানে অনিল আমার সব চেয়ে বড় ভরসার জায়গা। ‘স্লামডগ’ করে ও অস্কারে গিয়েছিল। এ বার আমার পালা। ও আমাকে বলে যে, প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করো।
‘সিলভার লাইনিং প্লে-বুক’-এ আপনার রোলটা কী রকম? বাকি পাঁচটা হলিউডি ছবিতে ভারতীয়দের যে রকম এক ঝলকের জন্য দেখা যায় তার চেয়ে কি আলাদা?
অবশ্যই। সেটা না হলে আমি মনোনীত হতাম না। এই চরিত্রটা বইতে ছিল। যখন ডেভিড ও রাসেল এই চরিত্রটার জন্য আমাকে পছন্দ করেন, উনি তিনটে জিনিস চেয়েছিলেন। টাক মাথা, সংবেদনশীল দু’টো চোখ, আর একটা দয়ালু মুখ। আমার মনে হয়, হলিউডের পরিচালকেরা গায়ের রং বা দেশ বিচার করে কাউকে চরিত্রের জন্য বাছেন না। তবে হ্যাঁ, বইয়ে চরিত্রটিকে একজন ভারতীয় মনোবিদ বলা হয়েছে। বিষয়টির সঙ্গে খাপ খাচ্ছে কি না সেটা বুঝেই হলিউডের পরিচালকেরা চরিত্রের জন্য অভিনেতা বাছেন।
আপনার ‘লাস্ট, কশন’-এর পরিচালক ছিলেন অ্যান লি। ওঁর ‘লাইফ অব পাই’ও তো অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছে। উনি পরিচালক হিসাবে রাসেলের থেকে কতটা আলাদা?
অ্যান লি অনেকটা গৌতম বুদ্ধের মতো। ও খুবই শান্ত স্বভাবের। ডেভিড সব সময়ই কাজের জন্য তৈরি। এতটাই প্রাণশক্তি ওর।
অস্কার দৌড়ে ভারতীয় সিনেমা এত পিছিয়ে কেন?
ফরেন সিনেমার ক্যাটেগরিতে ভারত থেকে অস্কারে গিয়েছিল ‘সারাংশ’। পুরস্কার পায়নি সেটা অন্য ব্যাপার। তবে আমার মনে হয় এই ধরনের ছবিই অস্কারে যাওয়া উচিত।
সারাংশ’-এর মতো আর কোনও সিনেমা করলেন না...
কত দশক হয়ে গেল মহেশ ভট্টের সিনেমায় অভিনয় করিনি!
ভারতীয়রা কি এখনও একই ধরনের সিনেমা বানিয়ে যাচ্ছে? এখনও সেই ইমোশনাল টাইপ?
প্রত্যেকটা প্রজন্মই অতীতকে মহান ভাবে দেখাতে চায়। তবে আমার মনে হয়, আমরাও এখন দারুণ সব সিনেমা তৈরি করছি। নীরজ পাণ্ডে, যার পরিচালনায় অভিনয় করেছি ‘আ ওয়েডনেসডে’ সিনেমায়, ‘স্পেশাল ছাব্বিশ’ নামে একটা ছবি তৈরি করেছে। ছবিটা অস্কারে পাঠানো উচিত ছিল। এত সমসাময়িক ছিল সিনেমাটা! আতঙ্কবাদ ছিল মূল বিষয়। এই বিষয়টা নিয়েই তো সারা বিশ্বের মাথাব্যথা।
বলা হয় ভারতীয় ছবি এমন অনেক বিষয় নিয়ে হচ্ছে যা বিদেশি সিনেমা করিয়েরা বছর তিরিশ আগেই বাতিল করে দিয়েছেন...
সত্যজিৎ রায়কে অস্কার দিতে অস্কার কমিটি কলকাতায় এসেছিল। বিষয়টা কিন্তু যথেষ্ট ভাবার মতো। এর কারণ একটাই। সত্যজিৎ যে ধরনের সিনেমা করেছেন, তার থেকে কোনও দিন বিচ্যুত হননি। তিনি তাঁর ধরনের সিনেমা তৈরি করতেন। যে কোনও বড় পরিচালকই তাই করে আসছেন। কুরোসাওয়াকে দেখুন। গদার, ফেলিনিদের দেখুন। আমাদের আধুনিক ভারত নিয়ে ছবি বানাতে হবে। মোহনলাল একটা দুর্দান্ত ছবি করেছে যেখানে ও নিজে একজন কথাকলি নৃত্যশিল্পী। এই ধরনের ছবিকে উচিত অস্কারে পাঠানো। অন্যান্য দেশগুলোকে দেখুন, অস্কারের বিদেশি ভাষা সংক্রান্ত বিভাগে ওরা ঠিক কী ধরনের ছবি পাঠায়। ‘সিনেমা প্যারাডিসো’, ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’। ইরানের সিনেমাগুলোকে কেন এত পছন্দ করা হচ্ছে? ইরান সমস্যা-জর্জরিত দেশ হওয়া সত্ত্বেও ওদের সিনেমাগুলো দেখুন! আঞ্চলিক ভাষার ছবিতেও ভাল কাজ হচ্ছে। অস্কারের জন্য ভারত থেকে চার-পাঁচটা আঞ্চলিক ছবি পাঠানো দরকার।
এখনকার পরিচালকদের ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
ভাল পরিচালকরা তো অবশ্যই রয়েছেন। আছেন অয়ন মুখোপাধ্যায়, দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকেরা। নীরজও একজন। ‘আ ওয়েডনেসডে’-র পর তো অনেককেই জানি যারা ওর সঙ্গে সিনেমা তৈরি করতে চেয়েছে। চার বছর অপেক্ষা করেছিল ও এই সিনেমাটাকে শেষ করতে। আজকাল অনেক পরিচালককেই দেখি প্রথম সিনেমাটা একটু অন্য ভাবে বানানোর চেষ্টা করে। তার পর ধারা পাল্টায়। অবশ্য আমিও যখন ইন্ডাস্ট্রিতে ‘স্ট্রাগলার’ ছিলাম, তখন মনমোহন দেশাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে চাইতাম। আমার সে বিষয়ে কোনও আক্ষেপ নেই। ‘সারাংশ’-এর ঠিক পরেই আমি করি ‘জওয়ানি’। লোকে বলে ‘‘ইয়ে তো আপনে কো বেচ দিয়া’’। শুধু ‘সারাংশ’-এর মতো ছবি করলে এত দিনে ৮-১০টার বেশি ছবি করা হত না আমার।
সব সফল পরিচালকই তো তারকাদের সঙ্গে কাজ করতে চান...
প্রত্যেকেই আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছতে চায়। এক জন পরিচালক যখন একটা ভাল ছবি বানান, সবাই তখন তাঁর সঙ্গেই কাজ করতে চায়। তিনি চাইলে যে কোনও অভিনেতাকেই পেতে পারেন। তাতেও কোনও ক্ষতি নেই। এমনকী সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত উত্তমকুমার আর শর্মিলা ঠাকুরকে নিয়ে ‘নায়ক’ করেছিলেন। কিন্তু দেখুন কী অসাধারণ একটি ছবি বানিয়েছিলেন! তা ছাড়া ‘শতরঞ্জ কী খিলাড়ি’। কী অপূর্ব ছবি। স্টার থাকা সত্ত্বেও তিনি সেটাই করে দেখিয়েছিলেন যা ওঁর কাছ থেকে আশা করা হয়। বর্তমানে বহু ভারতীয় পরিচালকই ‘তারেন্তিনো’ জ্বরে আক্রান্ত।
তাই না কি?
দেখুন পাশ্চাত্যের ছবি থেকে উদ্বুদ্ধ হওয়াই যায়। কিন্তু এটা বলা উচিত নয় যে, আমরা ভারতীয় সিনেমার একটা নতুন ধারা তৈরি করছি। বর্তমানে সব কিছু অনেক সহজলভ্য। মানুষ চাইলে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের সিনেমা দেখতে পারে। সুতরাং অনুকরণ করলে সেটা বোঝাই যাবে। আমি মোট ৪৭৫টি ছবিতে কাজ করেছি। এর মধ্যে খুব বেশি হলে ২০ থেকে ২৫টি আন্তর্জাতিক মানের। তবুও বাকিগুলো করেছি। কারণ আমি আসলে একজন ‘সিনেমাওয়ালা’। এটা করেই আমি খাই। ব্যাপারটা হল, একজন অভিনেতা আর ছুতোরের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। দু’জনেই খেটে খায়। অভিনেতা বলেই আমরা লাইমলাইটে থাকি। |
|
‘সিলভার লাইনিং প্লে-বুক’ ছবিতে অনুপম খের |
ভারতের অ্যাওয়ার্ড সেরেমনিগুলোতে কি সঠিক ভাবে দেশের প্রতিভা তুলে ধরা হচ্ছে? এখানে ব্যাপারটা ফর্মুলা-ভিত্তিক। আমি ‘আ ওয়েডনেসডে’তে প্রধান রোলে ছিলাম। কিন্তু সহ-অভিনেতা হিসাবে মনোনীত হয়েছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে যাইনি। ‘ম্যায়নে গাঁধী কো নেহি মারা’তে আমি হয়তো আমার সেরা অভিনয় করেছিলাম। কিন্তু সেটার জন্য মনোনীত হইনি। পাশ্চাত্যে এই ব্যাপারটা হয় না। টাইপকাস্টিং নেই। বয়সটা খুব একটা বড় ব্যাপার নয়। আপনার বয়স ৮৬ হোক বা ২০, আপনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর মনোনয়ন পেতেই পারেন।
সামনে আর কী পরিকল্পনা রয়েছে? ‘চশমে বদ্দুর’, তার পর ‘ন্যাশনাল রোমিং’। আরও আছে। আমি বই লিখেছি, মোটিভেশনাল ক্লাস নিই, তা ছাড়াও একটা অভিনয়ের স্কুল চালাই। রণবীর কপূরকে সেখানে ডেকেছিলাম। ও ভাল অভিনেতা। ‘বরফি’, ‘ওয়েক আর সিড’ আর ‘রকস্টার’-এর মতো ছবি করেছে। সব চেয়ে বড় কথা ও চরিত্রকে অভিনেতার দৃষ্টি দিয়ে দেখে, হিরোর দৃষ্টিতে নয়। তাই ও এই জায়গাতে পৌঁছেছে। অনেকেই সিনেমাতে হিরোর ইমেজ ছেড়ে বেরোতে পারে না।
সেন্সর বোর্ড নাকি একটা ফেস্টিভ্যাল করছে যেখানে দেখানো হবে কোন ছবি কোথায় কাটতে বলা হয়েছিল। প্রকল্পটা কেমন? আমি সেন্সর বোর্ডের চিফ ছিলাম। প্রকল্পটি ভাল। বোর্ডের নিয়মে অসুবিধা নেই। সেটা যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করাতেই যা সমস্যা দেখা দেয়।
পরিচালক না পলিটিশিয়ানকোন অবতারে আপনাকে দেখা যাবে? রাজনীতিতে আমি নেই। পরিচালক হওয়ার ইচ্ছেটা রয়েছে।
আপনার সহ-অভিনেতা রবার্ট ডি’নিরোর সঙ্গে অস্কার অনুষ্ঠানে তা হলে কী পরছেন? আপাতত ‘স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড’-এর অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারেই ভাবছি। আমার স্ত্রী কিরণও যাবে। ওখানে কেভিন কোস্টনার-এর সঙ্গে দেখা নিয়ে ও ভীষণই উত্তেজিত। অস্কারের ব্যাপারে ঠিক করেছি, মাথায় যে ক’টা চুল আছে সেগুলোকে ভাল করে আঁচড়ে যাব! |
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
|
|
|
|
|