শিল্প টানতে বুদ্ধের সাহায্য নিন, মমতাকে গৌতম
সিঙ্গুর-সঙ্কটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে একসঙ্গে বসিয়ে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাধানসূত্র বেরোয়নি। রাজ্য সরকারের শিল্প সম্মেলন ‘বেঙ্গল লিডস’ শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে সেই গৌতম দেবই আবার আবেদন রাখলেন মমতার কাছে। তাঁর বার্তা, বুদ্ধবাবুকে সঙ্গে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শিল্পমহলের কাছে যান। তাদের দেখান, শিল্পায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে তাঁরা একজোট। গৌতমবাবুর এই আবেদনকে অবশ্য গুরুত্ব দিচ্ছেন না শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। উল্টে তিনি জানান, বুদ্ধবাবুর আমলেই অন্ধকারে চলে গিয়েছিল রাজ্য। তাকে আলোয় আনছেন মমতা। সেই চেষ্টারই ফসল ‘বেঙ্গল লিডস’। যদিও শিল্পমহল মনে করছে, গৌতমবাবুর এই ডাক যদি ঐকান্তিক হয়, তা হলে সব সময়েই তা স্বাগত। শাসক-বিরোধী সমন্বয় শিল্পের পরিবেশই তৈরি করবে।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতমবাবু মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছে এই আবেদন রাখেন সোমবার রাজারহাটে দলীয় সমাবেশের মঞ্চ থেকে। বলেন, “জেদাজেদি না করে বুদ্ধবাবুকে সঙ্গে নিয়ে শিল্পপতিদের ডাকুন। উনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দু’জনে একসঙ্গে শিল্পপতিদের বলুন, আমাদের নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও, রাজ্যের উন্নয়নের জন্য আমরা এক।”
কেন এই ডাক দিলেন গৌতমবাবু? তাঁর কথাতেই, “শিল্পের জন্য আপনি (মমতা) ‘বেঙ্গল লিডস’ করছেন। তা নিয়ে ব্যঙ্গ করছি না। ওটা ব্যর্থ হলে খুশিও হব না। পশ্চিমবঙ্গ ক্রমেই শিল্পে পিছিয়ে পড়ছে। আপনি মুখ্যমন্ত্রী। এটা কি শুধু আপনার বদনাম?”
আজ থেকে হলদিয়ায় শুরু হচ্ছে রাজ্যের শিল্প সম্মেলন ‘বেঙ্গল লিডস’, যা গুজরাতের সদ্য সমাপ্ত শিল্প সম্মেলন ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর থেকে বহু মাইল পিছিয়ে। যখন শিল্পমহলের নক্ষত্র সমাবেশ ঘটিয়েছে গুজরাত, তখন বাংলায় অমাবস্যা। এই নিয়ে আগেই উঠেছিল প্রশ্ন কেন গুজরাত পারে, বাংলা পারে না?

‘‘জেদাজেদি না করে বুদ্ধবাবুকে সঙ্গে নিয়ে শিল্পপতিদের ডাকুন। উনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দু’জনে একসঙ্গে শিল্পপতিদের বলুন, আমাদের নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও, রাজ্যের উন্নয়নের জন্য আমরা এক।”

রাজারহাটের দলীয় সমাবেশে গৌতম দেব ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র

‘‘বুদ্ধবাবুদের সময়েই তো রাজ্য অন্ধকারে চলে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরং সেই আঁধার ঘুচিয়ে আলোর দিশা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।”

অনেকেই বলছেন, শিল্পের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে বাংলার থেকে অনেক এগিয়ে গুজরাত। কারণ, পশ্চিমের ওই রাজ্যে শাসক-বিরোধী একজোট হয়ে উন্নয়নের পক্ষে সরব হওয়াটা খুব চেনা রেওয়াজ। পশ্চিমবঙ্গে এই অভ্যাস বড়ই অচেনা। এ রাজ্যের রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ বলছেন, ৩৪ বছরের শাসনকালে বামেরা কত বার উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করেছে? উল্টো মতও অবশ্য রয়েছে। অনেকেই বলছেন, আলোচনা করতে গেলে কী ফল হয়, সেটা সিঙ্গুর নিয়ে রাজভবন ও তথ্যকেন্দ্রের বৈঠক থেকেই স্পষ্ট।
গৌতম দেব এ দিন সেই বৈঠকের প্রসঙ্গও তোলেন। বলেন, “তথ্যকেন্দ্রে বসিয়ে দিয়েছিলাম। বুদ্ধবাবু হাতে ধরতে বাকি রেখেছিলেন। বলেছিলেন, সব হবে। শুধু সিঙ্গুরটা করতে দিন।” কিন্তু মমতা সেই বৈঠকের মাঝপথে উঠে গিয়েছিলেন। সে কথা উল্লেখ করে গৌতমবাবু বলেন, “তখন আপনি (মমতা) রাজি হননি। সিঙ্গুর আজও লাশকাটা ঘরের মতো পড়ে আছে।” তার পরেই আবার তাঁর আবেদন, “কিন্তু এ বার বুদ্ধবাবুকে সঙ্গে নিয়ে শিল্পপতিদের বলুন, বাংলা বাঁচাতে আমরা একসঙ্গে আছি।”
গৌতম দেব যে শাসক-বিরোধী সমন্বয়ের কথা বলেছেন, সেটা শিল্পমহলেরও মনের কথা। রাজনীতির মধ্যে না ঢুকেও তাঁদের মত, উন্নয়নের প্রশ্নে এই সমন্বয়টা খুবই জরুরি। তাই বিরোধী নেতার এই প্রস্তাবকে তাঁরা স্বাগতই জানিয়েছেন।
বস্তুত, শাসক-বিরোধী সম্পর্ক উত্তপ্ত থাকে বলে এ রাজ্যে রাজনৈতিক ঝুঁকিও বেশি বলেই মনে করে শিল্পমহল। ষাট-সত্তরের দশকের জঙ্গি রাজনীতির পরেও এই ধারা বরাবরই লগ্নিকারীদের বিচলিত রেখেছে। তার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। বেড়েছে রাজনৈতিক ঝুঁকিও। এমন ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে ফোর্ড মোটর (ইন্ডিয়া)-এর মাইকেল বোনহ্যাম বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ লগ্নির জন্য আদর্শ গন্তব্য। কিন্তু রাজনৈতিক ঝুঁকি এখানে শিল্প গড়ার পথে বড় বাধা। শাসক ও বিরোধীদল যদি শিল্পায়ন নিয়ে একমত না হয়, তা হলে লগ্নির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হয়। কোনও লগ্নিকারীই চাইবেন না, হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রাজনৈতিক বিরোধিতায় তাঁর কারখানা বন্ধ হয়ে যাক।
এ দিন গৌতম দেবের আবেদন প্রসঙ্গে বেঙ্গল চেম্বারের প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্ত বলেন, “রাজনীতির কথা বলতে পারব না। কিন্তু বিরোধী দল যে উন্নয়নের প্রশ্নে বিরোধিতা করবে না, সেই বার্তা ঠিক হলে ও সর্বত্র তা পৌঁছলে শিল্পের পক্ষেই ভাল।”
কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দল নয়, উন্নয়নের প্রশ্নে সকলেই এগিয়ে এলে রাজ্যের পক্ষে ভাল মত ভারত চেম্বারের প্রেসিডেন্ট অশোক আইকতেরও। তবে তিনি বলেন, “দেখতে হবে, এটা যেন শুধুমাত্র রাজনীতি করার খাতিরে কথার কথা না হয়ে দাঁড়ায়।” এই সূত্রেই তাঁর দাবি, রাজ্যের রুগ্ণ আর্থিক অবস্থার পুনরুজ্জীবনেও সব রাজনৈতিক দল একসঙ্গে লড়াই করুক। তাতে কেন্দ্রের উপরে চাপও বাড়বে।
একই ভাবে বণিকসভার প্রাক্তন কর্তা সঞ্জয় বুধিয়াও মনে করেন, রাজ্যের উন্নয়নই বড় কথা। সকলকেই এ জন্য এগিয়ে আসতে হবে। রাজ্যের আর এক শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়া এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। সঞ্জীব গোয়েনকার সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
গৌতমবাবুর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্যকান্ত মিশ্র এবং গৌতম দেব এক এক রকম বলছেন। আগে ওঁরা ঠিক করুন, বাংলার মানুষ কার কথা শুনবেন। তা ছাড়া বুদ্ধবাবুদের সময়েই তো রাজ্য অন্ধকারে চলে গিয়েছে। মমতা বরং সেই আঁধার ঘুচিয়ে আলোর দিশা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।”
এ দিন কী বলছেন সূর্যকান্ত মিশ্র বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য? বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু এ দিন ‘বেঙ্গল লিডস’ নামের সূত্র ধরে সরকারকে কটাক্ষ করেন। বলেন, “কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলা সত্যিই নেতৃত্ব দিচ্ছে। যেমন, নারী নির্যাতনে। যেমন, বাজার থেকে ঋণ করার ব্যাপারে।”
আর বুদ্ধবাবু তুলনা টেনেছেন এই আমলের শিল্প-নীতির সঙ্গে তাঁর আমলের শিল্প-নীতির। তাঁর অভিযোগ, “গত দেড় বছরে হলদিয়ায় একটিও নতুন কারখানা হয়নি। কল-কারখানা না হলে কর্মসংস্থান হবে না সে কথা আমাদের আমলেও বলেছি। এখনও বলছি।” সিঙ্গুর প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “আমরা রতন টাটার পিছনে ছুটিনি। আমরা কর্মসংস্থানের পিছনে ছুটেছিলাম।” নন্দীগ্রাম এবং পরবর্তী কালে নয়াচরে পেট্রো-রসায়ন হাব তৈরি করতে না দেওয়ার জন্য তৃণমূলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বুদ্ধবাবুর বক্তব্য, “দেশে চারটি জায়গায় এই শিল্প গড়তে অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্র। গুজরাত, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশে হল। কিন্তু এ রাজ্যে হল না।”
বিরোধীদের এই সমালোচনার মুখে নিজের ব্লগে পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। তাঁর যুক্তি, মমতা ক্ষমতায় আসার ১৮ মাসের মধ্যে পাহাড় ও জঙ্গলমহলের সমস্যা মিটেছে, কর আদায় সরলীকরণ বা ১৪ ওয়াই ধারায় জমির ঊর্ধ্বসীমায় ছাড়ের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিল্পের সহায়ক পরিবেশ যে জরুরি, সে কথাও রাজ্য সরকার জানে। তাঁর দাবি, এই সব কিছু জেনে, শুনে, বুঝেই সিদ্ধান্ত নেবেন লগ্নিকারীরা। সরকার কারও উপর কিছু চাপিয়ে দেবে না। আর সেই সব কথা তুলে ধরার মঞ্চই হল ‘বেঙ্গল লিডস’।
ডেরেক অবশ্য মেনে নেন, প্রথম সারির শিল্পকর্তাদের যোগদান যদি সাফল্যের মাপকাঠি হয়, তা হলে হলদিয়া তার গুজরাতি সংস্করণের থেকে অনেক পিছনে। তাঁর কথায়, “মনের সুখে আমাদের দ্বিতীয় স্থানে বসাতে পারেন। আমরা কখনও এই দৌড়েই ছিলাম না।” তাঁর পাল্টা চ্যালেঞ্জ, “গুজরাত, মহারাষ্ট্র বা তামিলনাড়ু যে কোনও রাজ্য শুধু ৩৪ বছর বাম শাসনে থাকুক। তার পর দেখা যাবে তা কোথায় দাঁড়ায়!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.