মূল উপাদান বলতে দুধ, চালের গুঁড়ো এবং নারকেল। রাজবাড়ির পাকশালায় মিলত ক্ষীর এবং ভাল জাতের চাল, প্রজার হেঁশেলেও দুধ-চাল অমিল হত না (অবশ্যই কিছু কিছু দুর্ভিক্ষের সময় বাদে, সাহিত্যেও যার বর্ণনা আমরা পাই)। পিঠের অনায়াস গতায়াত তাই সর্বত্রই। যদিও গুণিজনেরা বলেন, পিঠের স্বাদ হয় হাতের গুণে। বহরমপুরের কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির সুপ্রিয়া রায় বলেন, “রাজবাড়ির অন্দরমহল আর আশপাশের পাড়া-প্রতিবেশীদের রান্নাঘর থেকে মকর সংক্রান্তির দিন আসত পিঠে-পুলির সুবাস।” পৌষের শেষে নতুন তোলা ধান ও চালের গন্ধ ভরিয়ে রাখত সারা বাংলার মতো কাশিমবাজারকেও। সুপ্রিয়াদেবীর মনে পড়ে, “ঘন জ্বাল দেওয়া দুধের গন্ধ পিঠে খাওয়ার ইচ্ছেটা আরও বাড়িয়ে দিত। পিঠে বানানোর বিশেষজ্ঞ ছিলেন কয়েক জন। তাঁদের কদর বেড়ে যেত এই সময়ে।” অনেক সময়ে পুরুষেরাও হাত লাগাতেন পিঠে তৈরিতে। কান্দির জেমো রাজবাড়ির ফুল তরফের বর্তমান বংশধর কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ রায় বলেন, “বাজারসৌ-এর জমিদার ব্রাহ্মণ অজিত দুবে নিজে হাতে পিঠে ও পুলি বানাতেন। অপূর্ব ছিল তার স্বাদ। শান্তি পাঠকের হাতে গড়া পিঠেতে আমাদের রাজবাড়ির ভোগশালা ভরে থাকত।” জঙ্গিপুরের জমিদার সিংহবাড়ির পুত্রবধূ অলোকদেবী বলেন, “দুধ, নারকেল আর চালের গুঁড়ো এই তিন দিয়ে যে কত কী করা যায়, তা জানতেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা। আমি কিছুটা শিখেছিলাম। আনন্দের কথা, এখনও কিন্তু তার কদর কমেনি।”
নদিয়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পরিবার হেমন্ত ও শীতে প্রচুর উৎসবের আয়োজন করত। বর্তমান রাজবধূ অমৃতা রায় ভুলতে পারেন না “মকর সংক্রান্তি ছিল আমাদের পরিবারের অন্যতম প্রধান উৎসব। আমার শাশুড়ি জ্যোতিমর্য়ীদেবীর আমল পর্যন্ত সেই জাঁকজমক বজায় ছিল। সংক্রান্তির আগের দিন সকাল থেকে তাঁর তদারকিতেই তৈরি হত রকমারি পিঠে। সংক্রান্তির ভোরে গঙ্গায় স্নান সেরে তিনি প্রথমে গৃহদেবতাকে পিঠে-পুলি উৎসর্গ করতেন। তার পরে আত্মীয়-পরিজনদের বাড়ি-বাড়ি পাঠাতেন। সে দিন যে কোনও কাজ নিয়ে রাজবাড়িতে আসা কাউকে পিঠে-পুলি না খাইয়ে ছাড়া হত না।” মকর সংক্রান্তির পিঠে-পুলি এমন এক ব্যতিক্রমী উৎসবের সুগন্ধবাহী, যা অন্দরমহল থেকেই নিয়ন্ত্রিত হত। তামাম কেক-প্যাস্ট্রি-কুকিজের আটঘাট ডিঙিয়ে আজও তা বাঙালির অন্তরমহল মাত করে রেখেছে। |