কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের বরাদ্দ মঞ্জুর হয়েছিল বছর দুয়েক আগেই। ঠিকাদার নিয়োগও সেরে রেখেছিল রেলমন্ত্রক। কিন্তু মহাকরণের সবুজ সঙ্কেত না পাওয়ায় থমকে ছিল উত্তরবঙ্গের তিনটি অভয়ারণ্য চিরে যাওয়া রেলপথে বণ্যপ্রাণী চলাচলের জন্য দু’টি আন্ডারপাস তৈরির কাজ।
ছুটন্ত ট্রেনের ধাক্কায় ক্রমান্বয়ে হাতি-হনন রুখতে এ বার তাই রাজ্যের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে ওই আন্ডারপাস (রেলের পরিভাষায় গার্ডার ব্রিজ) তৈরিতে হাত দিল রেল।
হাতি-করিডর মহানন্দা অভয়ারণ্যের গুলমায় কাজ শুরু হয়েছে সম্প্রতি। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের এডিআরএম বি লাকরা জানান, “বরাদ্দ হাতে পাওয়ার পরে, রেলমন্ত্রক গত দু’বছর ধরে আন্ডারপাস তৈরির জন্য রাজ্যের অনুমোদন চেয়ে বার বার চিঠি দিয়েছে। উত্তরই মেলেনি। দমনপুরের দুর্ঘটনার পরে তাই আর বিলম্ব না করে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে।” ওই কাজে বরাত-পাওয়া সংস্থার পক্ষে বিশ্বজিৎ দত্ত বলেন, “মহানন্দা অভয়ারণ্যের উত্তর রেঞ্জে আন্ডারপাসের নকশা তৈরি। আশা, মাস ছয়েকের মধ্যেই প্রথম সুড়ঙ্গটি তৈরি হয়ে যাবে।” বিশেষজ্ঞদের অনুমান, করিডর ব্যবহারের সময়ে হাতি লাইনে না উঠে সুড়ঙ্গর আদলে তৈরি আন্ডারপাসই বেছে নেবে। |
বন্যপ্রাণের নিরাপত্তার প্রশ্নেও ছায়া ফেলল কেন্দ্র-রাজ্য কাজিয়া। —নিজস্ব চিত্র |
হস্তি বিশেষজ্ঞ ধৃতিকান্ত লাহিড়ি চৌধুরী অবশ্য সন্দিহান, “হাতিরা ওই পথে যাবে তো!” প্রজেক্ট এলিফ্যান্টের কর্তা এএন প্রসাদ আশ্বস্ত করছেন, “এক বার চলাচল শুরু করলে রেললাইন ছেড়ে হাতিরা সুড়ঙ্গই ব্যবহার করবে।”
ওই আন্ডারপাস হলেই যে দুর্ঘটনায় লাগাম টানা যাবে, এমন অবশ্য মনে করছে না রেলমন্ত্রক। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলেন, “আন্ডারপাস হলেই সব সমস্যার সমাধান হল, এমন নয়। তবে কাজিয়া এড়িয়ে একটা সদর্থক পদক্ষেপ তো করা গেল।”
কিন্তু কাজিয়া মেটেনি কেন? রেলের দাবি, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের হাতেই এত দিন রেলের দায়িত্ব ছিল। সমস্যা মেটাতে তারা চেষ্টাই করেনি। অধীর বলেন, “গত দু’বছরে তিন জন রেলমন্ত্রী বদলেছে তৃণমূল। কিন্তু এ নিয়ে দিল্লি-মহাকরণ সংঘাত মেটানোর চেষ্টা করেনি।”
মহাকরণের পাল্টা দাবি, মহানন্দা অভয়ারণ্যে মাত্র কয়েকশো মিটারের ব্যবধানে দু-দু’টি আন্ডারপাস না গড়ে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বরং বনোন্নয়নের কাজে খরচ হোক। কেন্দ্রীয় বনমন্ত্রক অবশ্য সে ব্যাপারে সায় দেয়নি।
২০০৯ সালে, কেন্দ্রীয় বনমন্ত্রী জয়রাম রমেশ দু’টি আন্ডারপাস গড়তে ১.৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। চুক্তি অনুযায়ী কাজের দায়িত্ব বর্তেছিল রেলের উপর। সুড়ঙ্গ কোথায় হবে তা দেখতে এলাকা সরেজমিন ঘুরেও যান রেল ও রাজ্যের প্রতিনিধিরা। ২০১১ সালে আচমকাই রাজ্য প্রস্তাব দেয়, আন্ডারপাস হোক একটিই। বন দফতরের এক শীর্ষ কর্তাও স্বীকার করেন, “আন্ডারপাস নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন তুলে কাজটা থমকে দেওয়া ছাড়া রাজ্য আর কিছুই করেনি।” তিনি জানান, লালপুরে আন্ডারপাস না
গড়ে ওই টাকায় বন সংরক্ষণের কাজের দাবি তুলতেই ওই কাজে দাঁড়ি পড়ে যায়।
কাজ থমকে থাকা নিয়ে বনমন্ত্রী হিতেন বর্মনের কাছে স্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি। বন দফতরের চিফ ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন সুধাংশুবিকাশ মণ্ডল অবশ্য আঙুল তুলছেন রেলের দিকেই। বলেন, “দুর্ঘটনা এড়াতে রেলমন্ত্রককে একাধিক প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিছুই মানা হয়নি। দায় এড়াতে রেল এখন এ সব যুক্তি খাড়া করছে।”
গুলমার ওই জায়গায় তীক্ষ্ন বাঁক। বাঁকের মুখটিও বেশ সংকীর্ণ। ফলে হস্তিযূথ ওই বাঁকের মুখে চলে এলে ট্রেনের আলো বা হুইসেল শুনেও লাইন থেকে নামতে পারে না। ঝোপঝাড়ও দেদার। গত দেড় বছরে তা সাফাইও হয়নি। কেন? সীতাংশুবাবুর যুক্তি, “বন দফতরের টাকা নেই।”
বছর গড়িয়ে গিয়েছে। কাজিয়া মেটেনি। তাদের চেনা করিডরে চলাচল করতে গিয়ে খেসারত দিয়েছে কখনও হাতি কখনও বা বাইসন, সম্বর, পাইথন এমনকী একটি লেপার্ডও।
এ বার সেই সুড়ঙ্গ পথে কি আলো দেখছে হস্তিযূথ? |