প্রবন্ধ...
ধুম মচানোর ডাক
হিন্দি সিনেমার পর্দায় হৃতিক রোশন, জন আব্রাহামরা তাও মাঝে মাঝে ধুম মচিয়েছেন! আমরা, বিবেকানন্দের উত্তরসূরি বাঙালিরা তাও পারিনি!
হিন্দি ছবির বহু আগে তরুণদের ধুম মচানোর ডাক দিয়েছিলেন তিনি। ১৮৯৪ সালে কলকাতার বরাহনগর মঠে সতীর্থ রামকৃষ্ণানন্দকে নিউ ইয়র্ক থেকে লিখছেন বিবেকানন্দ, ‘কুছ পরোয়া নেই। দুনিয়াময় ধূমক্ষেত্র মাচাতে হবে, এর কম চলবে না।’ কারা ধুম মচাবে? উপনিষদ উদ্ধৃত করে বলবেন ‘আশিষ্ঠো দ্রঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠো মেধাবী আশাপূর্ণ, বলিষ্ঠ, দৃঢ়চেতা ও মেধাবী যুবকগণই ঈশ্বর লাভ করবে।’
ধুম মচানো, যুবক, তারুণ্য...স্বামী বিবেকানন্দের লেখায় এই সব শব্দ বারংবার এসেছে। কারণটা পরিষ্কার। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটি আইডিয়া আছে। বাইরের মানুষটা সেই আইডিয়ার বহিঃপ্রকাশ।’ সে রকম, তাঁর জীবনের মূল ‘আইডিয়া’ সতেজ, ছটফটে তারুণ্যের। চেন্নাইতে ‘ভারতীয় জীবনে বেদান্তের কার্যকারিতা’ নিয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সাফ জানালেন, ‘হে যুবক বন্ধুগণ, আগে তোমরা সবল হও। ধর্ম-টর্ম পরে আসবে। গীতা পাঠের চেয়ে ফুটবল খেললে স্বর্গের আরও কাছে যেতে পারবে।’ পৃথিবীর কোনও মন্ত্রদ্রষ্টা এই ভাবে কথা বলেননি।
শিকাগো ধর্মমহাসভার দুই বছর আগের ঘটনা। বিবেকানন্দ তখন বেলগাঁওয়ে হরিপদ মিত্র নামে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে। হরিপদবাবু সরকারি অফিসার, ইংরেজ ওপরওয়ালার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি। কিন্তু চাকরিটি ভাল, রোজগার যথেষ্ট। ফলে ছাড়তেও পারেন না। রোজ সন্ন্যাসীর কাছে সে নিয়ে দুঃখ করেন। বিবেকানন্দ বললেন, “চাকরিটা কেন করো? টাকার জন্য। তা হলে এ সব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তোলপাড় কেন? যদি না পোষায়, ছেড়ে দাও। ওপরওয়ালার কিছু আসবে-যাবে না। এখনই একশোটা লোক ওই পদের প্রার্থী হবে। অথবা আর একটা কাজ করো। আমরা নিজেরা যেমন, বাইরেও সে রকম দেখি। ওপরওয়ালাদের দোষ দেখা ছেড়ে দাও। দেখবে, ওদের মনোভাবও ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে।”

নিজভূমে পরবাসী। বিবেকানন্দের সাজে দেব, ১২ জানুয়ারি ২০১৩
সার্ধশতবর্ষে এই গল্পটি ফের মনে করানোর কারণ দুটি। এক, আর্থিক মন্দার যুগে এই গল্পের কার্যকারিতা আজও চমৎকার। দুই, বিবেকানন্দের তারুণ্য-সংযোগ। রামকৃষ্ণও তরুণ ভক্তদের ভালবাসতেন, বাড়ি গিয়ে সন্দেশ খাইয়ে আসতেন। কিন্তু চাকরি তাঁর দু’ চোখের বিষ। ‘পরের দাসত্ব’, ‘স্বাধীনতা চলে যায়’ ইত্যাদি বলেছেন। বিবেকানন্দ কিন্তু হরিপদবাবুকে সে রকম কিছু বলেননি, কামিনীকাঞ্চন ছাড়ার উপদেশ দেননি। কিন্তু চাকরিজীবী তরুণ কোন রাস্তায় এগোবেন, বলে দিয়েছিলেন। একটিই জিনিস চেয়েছেন তিনি। তরুণরা জীবনের মোকাবিলা করুক, হাল ছেড়ে না দিয়ে। তাঁর কাছে একটি ছেলে আসত, সে সন্ন্যাসী হতে চায়। বার দুয়েক এম.এ পরীক্ষায় বসেও সে পাশ করতে পারেনি। তিনি তাকে বলেন, ‘‘তুমি বরং আগে এম.এ-টা পাশ করে এসো। সন্ন্যাসী হওয়ার চেয়ে এম.এ পাশ করা ঢের সহজ।’’
জীবনের সঙ্গে মোকাবিলার রাস্তাটাও তরুণদের দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি, ‘তেজস্বী হও, উঠে দাঁড়াও, বীর্য অবলম্বন করো।’ উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, ‘জগতের সাহিত্যে কেবল উপনিষদেই ‘অভীঃ’ শব্দ বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে। ভয়হীনতা আসবে কোত্থেকে? বাতলে দিচ্ছেন সন্ন্যাসী, ‘বিশ্বাস, বিশ্বাস, বিশ্বাস... নিজের ওপর বিশ্বাস... এটাই উন্নতিলাভের একমাত্র উপায়। তোমার যদি তেত্রিশ কোটি দেবতার সবগুলির ওপর বিশ্বাস থাকে, অথচ আত্মবিশ্বাস না থাকে, কখনই তোমার মুক্তি হবে না।’ ভয়ডরহীন এই আত্মবিশ্বাসের উৎস উপনিষদ। ‘আমি আত্মা, তরবারি আমাকে ছিন্ন করতে পারে না, যন্ত্র আমাকে ভেদ করতে পারে না, অগ্নি আমাকে দাহ করতে পারে না...এই আশাপ্রদ মুক্তিপ্রদ বাক্যগুলি সবসময় উচ্চারণ করো,’ বলছেন বিবেকানন্দ। তাতে লাভ? ‘ছাত্র যদি নিজেকে আত্মা বলে ভাবে, সে ভাল বিদ্যার্থী হবে। উকিল যদি নিজেকে আত্মা বলে চিন্তা করে, সে ভাল আইনজ্ঞ হবে।’
আত্মবিশ্বাস থাকলেই তরুণরা নিজেদের শ্রদ্ধা করবে। শ্রদ্ধা করবে অন্যদের, মুচি মেথর চণ্ডাল সবাইকে। পরাধীন দেশে সর্বত্র দুর্বল মানসিকতা, শ্রদ্ধার অভাব। ‘জেনেছি, আমরা বিজিত, দুর্বল। কোনও বিষয়ে আমাদের স্বাধীনতা নেই। এতে আর শ্রদ্ধা নষ্ট হবে না কেন?’ প্রশ্ন তাঁর। শ্রদ্ধাই তাঁর তারুণ্য-দর্শনের মূল কথা। কঠোপনিষদের ‘যম ও নচিকেতা’র গল্পটি তাঁর খুব প্রিয়। বাড়িতে যজ্ঞ হচ্ছে, বাবা দানধ্যান করছেন। নচিকেতার প্রশ্ন, ‘আমাকে দান করলেন না? কাকে করলেন?’ বিরক্ত বাবা বললেন, ‘যমকে দিলাম।’ নচিকেতা যমের কাছে চলে গেলেন, জীবনের অর্থ ও নানা দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর জেনে এলেন। বিবেকানন্দ বুঝিয়ে দেন, ‘নচিকেতার হৃদয়ে শ্রদ্ধা প্রবেশ করেছিল। শ্রদ্ধা জাগামাত্র তার মনে হল, আমি অনেকের মধ্যে প্রথম বা মধ্যম। কিন্তু অধম নই। আমিও কিছু কাজ করতে পারি।’ শিষ্যকে বললেন, ‘নিজেরা শ্রদ্ধাবান হয়ে দেশে শ্রদ্ধা নিয়ে আয়। নচিকেতার মতো যমলোকে চলে যা, আত্ম উদ্ধারের জন্য।’
তরুণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, শ্রদ্ধা জাগানোর এই ভাব প্রচার করা হবে কী ভাবে? উৎসবের মাধ্যমে। বেলুড়ে দুর্গাপুজো থেকে অনেক উৎসবই বিবেকানন্দের ব্রেনচাইল্ড। উৎসব তাঁর কাছে আর কিছুই নয়, ভাব প্রচারের সূচনা। তাঁর জন্মভূমিতে অবশ্যই উৎসব কথাটার এখন অন্য অর্থ। কাজে লাগা নয়, তরুণ মনে আত্মবিশ্বাস জাগানো নয়, শ্রদ্ধা কথাটির মানেও কেউ জানে না। প্রবল উৎসব সত্ত্বেও সার্ধশতবর্ষে বিবেকানন্দ তাই নিজভূমে পরবাসী হয়েই থেকে গেলেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.