|
|
|
|
সাক্ষাৎকার ... |
ছোট চাষিদের নিজস্ব সংহতি দরকার |
জমি সংক্রান্ত প্রায় সব আলোচনাই এখন অধিগ্রহণ নিয়ে। গত সপ্তাহে কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল
ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ‘ওয়ার্কশপ অন ইকনমিক গ্রোথ ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর উদ্বোধনী ভাষণে ইউনিভার্সিটি
অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে-র অর্থনীতির অধ্যাপক প্রণব বর্ধন জমি নিয়ে অন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে
আলোচনা করেছিলেন। সেই সূত্র ধরে তাঁর সঙ্গে একটি একান্ত কথোপকথন। সাক্ষাৎকারে অমিতাভ গুপ্ত |
|
আপনি বলছিলেন, ভূমি সংস্কারের কিছু পরোক্ষ ফল হয়েছে, যেগুলো রীতিমতো উল্লেখযোগ্য।
বস্টন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক দিলীপ মুখোপাধ্যায় আর আমি ১৯৮২ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ৯০টা গ্রামের কৃষি উৎপাদনশীলতা নিয়ে অনেকখানি চর্চা করেছি। ভূমি সংস্কারের একটা প্রত্যক্ষ ফল বহু-আলোচিত পাট্টার মাধ্যমে কিছু কৃষক জমির মালিকানা পান, আর বর্গা নথিভুক্ত হওয়ার ফলে বর্গাদারদের একটি নির্দিষ্ট জমিতে চাষের অধিকার পাকা হয়। ফলে, ভূমি সংস্কার কৃষকের চাষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। কিন্তু নমুনা সমীক্ষায় দেখছি, পাট্টা দেওয়ার ফলে সে ভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়েনি। কারণ যে জমি তেমন উর্বর নয়, উৎপাদনশীলতা কম, তেমন জমিই সাধারণত পাট্টার মাধ্যমে বণ্টন করা হয়। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, যেখানেই ভূমি সংস্কার হয়েছে, সেখানেই মোটামুটি এই ঘটনা ঘটেছে।
কিন্তু বর্গার মাধ্যমে জমির উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। একেবারে সাংঘাতিক রকম না হলেও ভালই বেড়েছে। ধরো, যে বর্গাদার বর্গা নথিভুক্ত হওয়ার ফলে পাকাপাকি চাষের অধিকার পেয়েছেন, তাঁর ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, এটা প্রত্যাশিত কারণ তিনি বর্গা নথিভুক্ত হওয়ায় নিশ্চিত হলেন যে পরের বছরও ওই জমিতে তিনিই চাষ করবেন। ফলে তিনি নিজের জমিতে বিনিয়োগ করবেন, তাতে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। কিন্তু আমরা তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলাম, যে জমি বর্গার আওতাভুক্ত নয়, অর্থাৎ যেখানে মালিক নিজেই চাষ করেন, সেখানেও অপারেশন বর্গার ফলে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। ভেবে দেখলে, এটা রীতিমতো আশ্চর্য একটা ব্যাপার। যেটা হয়েছে, তা হল, বর্গা নথিভুক্ত হওয়ার পর যেহেতু বর্গাদাররা নিজেদের জমিতে বিনিয়োগ করতে আরম্ভ করলেন, যেমন জল কিনলেন, তাতে জলবিক্রেতাদের টিউবওয়েল ইত্যাদিতে বিনিয়োগের উৎসাহ বাড়ল, ফলে জমিপিছু জলের খরচ কমল। আরও বেশি জল ব্যবহার করা সম্ভব হল। সেচের ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা। অথচ, ভূমি সংস্কারের কোনও আলোচনাতেই এই দিকটা এখনও বিশেষ শোনা যায়নি।
ভূমি সংস্কার ব্যাপারটা তো রাজনৈতিক গুরুত্ব হারিয়েছে। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরাও এখন আর ভূমি সংস্কারের কথা বলেন না।
ভূমি সংস্কার নিয়ে আর কিছু করার নেই, এই ধারণা ভুল। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের কথা বলছি না, কিন্তু সব দলই এই ব্যাপারটাকে নিজেদের কর্মসূচিতে রাখতে পারে। বিশেষত সেচের ক্ষেত্রে ভূমি সংস্কারের পরোক্ষ ফল খুব বেশি এবং ইতিবাচক। অনেক কিছু করার আছে এখনও। মুশকিল হল, ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় ভূমি সংস্কারের ফলে যতটা অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার ছিল, সেটা পাওয়া হয়ে গিয়েছে। স্বভাবতই পুরনো প্রযুক্তিতে এক সময় উৎপাদনশীলতার ওপর ভূমি সংস্কারের প্রভাব কমে আসবে। সেটাই হয়েছে। এর থেকে পরের দফায় সুবিধা পাওয়ার জন্য নতুন প্রযুক্তির কথা ভাবতেই হবে। এখন বহুমূল্য কৃষিপণ্যের দিকে তাকাতে হবে। তার জন্য পরিকাঠামো দরকার হিমঘর চাই, রাস্তা চাই, বিদ্যুৎ চাই, বেশি চাই কৃষি বিপণন। পশ্চিমবঙ্গে কোনওটাই যথেষ্ট হল না, হচ্ছেও না। মাঝখান থেকে ভূমি সংস্কার ব্যাপারটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। |
|
পশ্চিমবঙ্গে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করা যায় এখানে একই সঙ্গে ভূমি সংস্কারও হয়েছে, আবার জমির মালিকানার ক্ষেত্রে বৈষম্যও বেড়েছে। দুটো একই সঙ্গে কী ভাবে সম্ভব হল?
দিলীপ মুখোপাধ্যায় আর আমি এই প্রশ্নটা নিয়েও চর্চা করেছি। আর একটা নমুনা সমীক্ষায় আমরা ১৯৬৭ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ২৪০০ পরিবারের জমি হস্তান্তরের ধরন দেখেছি। বস্তুত, পরিবারের হাতে জমির পরিমাণ বাড়া বা কমার পিছনে ভূমি সংস্কারের ভূমিকা অতি সামান্য। বাজারে কেনা-বেচারও একটা ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু মালিকানায় থাকা জমির পরিমাণ প্রধানত বদলেছে পরিবার ভাগ হওয়ার ফলে। মানে, বাবার জমি ছেলেদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়ার ফলে প্রত্যেকের হাতে থাকা জমির পরিমাণ কমেছে। খেয়াল করো, ছেলেদের মধ্যে ভাগ হওয়ার কথা বললাম, মেয়েরা এই ভাগের হিস্যা পায় না। সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। পরিবারের মধ্যে জমি ভাগ হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, হাতে থাকা জমির পরিমাণ আধ একরের কম। বিভিন্ন তথ্য থেকে আমাদের অনুমান, এই আধ একরের মাপটা গুরুত্বপূর্ণ। কারও জমির মাপ আধ একরের কম হলে সেই জমিতে চাষ করা অর্থনৈতিক ভাবে অসম্ভব যা খরচ হবে, ফসল বেচে তা কুলিয়ে ওঠা যাবে না। ফলে, যখনই কারও জমির মাপ আধ একরের নীচে চলে যাচ্ছে, তিনি আর চাষ করছেন না। জমি বেচে দিচ্ছেন, বা ফেলে রাখছেন। এই প্রান্তিক চাষিরা কার্যত ভূমিহীন কৃষিমজুরে পরিণত হচ্ছেন। যত দিন যাবে, যত বেশি জমি ভাগ হবে, এই সমস্যা ততই বাড়বে। মা-মাটি-মানুষের স্লোগান দিলেই তো আর হবে না। বর্তমান অবস্থায় ক্ষুদ্র জমিতে খেতের মাটি থেকে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে না। এই মানুষগুলোর কথা ভাবতে হবে।
সেই ভাবনা কোন পথে যাবে?
সমবায়ের কথা ভাবা উচিত। সমবায় চাষের কথা বলছি না, তাতে অনেক রকম সমস্যা আছে। কিন্তু কিছু কাজ অবশ্যই জোট বেঁধে করা উচিত। যার জমির মাপ আধ একর, তিনি একা সার কিনতে গেলে যে দামে সার পাবেন, ৩০ জন এক সঙ্গে কিনলে অনেক কম দামে পাবেন। সেচের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সবচেয়ে বড় কথা, জোট বেঁধে বিপণন করতে হবে। একার জমিতে যেটুকু ফসল হবে, সেটা নিজে বেচতে গেলে কম দামে ফড়ের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ৩০ জন, বা ৩০০ জন এক সঙ্গে বেচলে দরাদরির ক্ষমতা বাড়ে। কৃষি বিপণনে সমবায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ রয়েছে গুজরাতের আনন্দে আমুল দুধের বিপণনে এই গোটা বিপ্লব তো ভারত দেখেছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে সেই সমবায়ের ব্যবস্থা করা গেল না কেন?
সেই দায় কি বহুলাংশেই বামফ্রন্ট সরকারের নয়?
অবশ্যই। বামপন্থীদের উচিত ছিল এই সমবায়ের কথা ভাবা। বিশেষ কিচ্ছু করেনি। যে কয়েকটা সমবায় প্রতিষ্ঠান আছে, তার বেশির ভাগই আমলাতান্ত্রিকতায় বিপর্যস্ত। |
|
চুক্তিচাষের মাধ্যমে কি এই সমস্যার সমাধান হতে পারে? ধরুন, পেপসি-র মতো কোনও সংস্থা চাষিদের আলু চাষ করতে বলল। যা উৎপাদন হবে, সেটা তারাই কিনে নেবে। বিপণন নিয়ে ভাবার আর দরকার হল না।
আমার মনে হয় না, চুক্তিচাষের ব্যবস্থা হলেই সব সমস্যা মিটে যাবে। ওয়ালমার্ট, পেপসি হোক, অথবা রিলায়েন্স, বড় সংস্থার পয়সা আছে। ওরা হিমঘরের ব্যবস্থা করতে পারবে। কিন্তু চাষিদের পয়সা দেবে কি? চাষিদের পয়সা পাওয়ার উপায় হল দর কষাকষির ক্ষমতা তৈরি করা। প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র চাষিদের যদি সেই ক্ষমতা তৈরি করতে হয়, জোট বাঁধতেই হবে। সমবায় তৈরি করতে হবে।
সরকার সেই সমবায় তৈরি করে দিতে পারে?
সরকার করলেই হাজার ঝামেলা— এই ফর্ম ভর্তি করো, ওইখানে লাইন দাও, আমলাদের কথায় ওঠো-বসো! তার চেয়ে কোনও স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক পার্টি করুক। যে পার্টিই হোক, উদ্যোগ করে চাষিদের একজোট করুক। চাষিদের হয়ে দরকষাকষি করুক। এটা যে দলই করুক, আমি সমর্থন করব। সিপিএম করলেও, তৃণমূল করলেও।
আপনি বলছিলেন, পরিবারের জমি বাঁটোয়ারার সময় মেয়েরা ভাগ পায় না। হঠাৎ এই প্রসঙ্গটা কেন তুললেন?
এই প্রসঙ্গটা তো বিশেষ কেউ তোলেই না! পশ্চিমবঙ্গে মোট কৃষিজমির কতটা মেয়েদের মালিকানায় আছে, জানার কোনও উপায়ই নেই। সে বিষয়ে তথ্যই সংগ্রহ করা হয় না। যত দূর জানি, গোটা দেশে একমাত্র কর্নাটকে সম্প্রতি একটা বড় মাপের সমীক্ষা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, মোট কৃষিজমির ১৪ শতাংশের মালিক মেয়েরা, ১৫ শতাংশ জমি পুরুষ-নারীর যৌথ মালিকানায় রয়েছে, আর বাকি ৭১ শতাংশ জমির মালিক পুরুষরা। পশ্চিমবঙ্গে অবস্থা এর চেয়ে ভাল হবে, ভাবার কোনও কারণ নেই। অর্থাৎ, আমাদের দেশে মেয়েরা কৃষিশ্রমিক, মালিক নয়। বাপের জমি ভাগ হওয়ার সময় মেয়েরা বাদ পড়েন। শ্বশুরবাড়ির জমিতেও তাঁদের স্বত্ব থাকে না। ফলে তাঁদের নিজস্ব জীবিকার কোনও স্বাধীনতা থাকে না। একটু আগে বলছিলাম, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র কৃষকদের দরকষাকষির ক্ষমতা নেই। তাঁদের বাড়ির মেয়েদের কথা চিন্তা করো এক বার! সেই মেয়েরা দরকষাকষির ক্ষমতায় পরিবারের পুরুষদের তুলনায় একেবারে কিছুই নয়। হাজার রকম অত্যাচার সয়েও শ্বশুরবাড়িতেই থেকে যেতে হয়। অথচ কোনও রাজনৈতিক দল এই প্রসঙ্গটা তোলেই না। বেশির ভাগ গবেষকও এটা নিয়ে ভাবেন না। |
|
|
|
|
|