জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হইয়া উঠিতেছে। এক দিকে পাকিস্তানের সহিত প্রকৃত সীমান্তরেখা বরাবর সংঘর্ষ ও গুলিবিনিময়ের ঘটনা রাজ্যের অভ্যন্তরে উত্তেজনা ও আশঙ্কার আবহ রচনা করিয়াছে। অন্য দিকে জঙ্গিদের দাপটে সরপঞ্চদের ইস্তফা দেওয়ার হিড়িক রাজ্যে আইনের শাসন বলবৎ থাকার বিষয়েই সংশয় জাগাইয়া তুলিয়াছে। ২০১১ সালে তিন দশকেরও অধিক কাল পরে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এ যাবৎ জঙ্গিরা মোট ছয় জন সরপঞ্চকে হত্যা করিয়াছে। মহিলা সরপঞ্চ জুনা বেগমকে হত্যার চেষ্টা এবং তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার ঘটনাও জঙ্গিদের অভীষ্ট সিদ্ধ করিয়াছে। বারামুল্লা জেলার অন্তত কুড়ি জন নির্বাচিত সরপঞ্চ জঙ্গি হুমকি শিরোধার্য করিয়া পদত্যাগী।
জঙ্গিরা কেন সরপঞ্চদের লক্ষ্যবস্তু বানাইয়াছে, অনুমান করা কঠিন নয়। এই সরপঞ্চরা স্থানীয় জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। স্থানীয় উন্নয়ন ও জনকল্যাণের বিবিধ কর্মসূচির সহিত তাঁহারা যুক্ত। তাঁহাদের সাফল্য ও জনপ্রিয়তা কাশ্মীরে জেহাদি সন্ত্রাসের জমিকেই দুর্বল করিয়া দেয়। উন্নয়নের প্রশ্নে রাজ্যবাসী যে শ্রীনগর ও নয়াদিল্লির সরকারের পাশেই থাকিতে চাহেন, এই বিষয়টিও জঙ্গিদের পছন্দ নয়। তাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পদত্যাগে বাধ্য করিয়া তাহারা স্থানীয় স্তরে উন্নয়নের সরকারি উদ্যোগ বানচাল করিতে তৎপর। সরকারের কাছে সরপঞ্চরা একাধিক বার নিরাপত্তা চাহিয়াছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা জঙ্গি হানায় সরপঞ্চদের মৃত্যুর ঘটনাকে স্থানীয় কিংবা সম্পত্তি লইয়া বিবাদের জের আখ্যা দিয়া নিরাপত্তার প্রয়োজনটি লঘু করিয়া দেন। সরপঞ্চরা ক্ষুব্ধ হন। এ জন্যই গণ-ইস্তফার হিড়িক পড়িয়াছে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জেহাদি মতাদর্শ যে উপত্যকায় বিলক্ষণ অটুট, পুলিশ ও আধাসেনার তরফে সামান্য প্ররোচনাতেই তাহা বারংবার প্রকট হয়। কট্টরপন্থী মোল্লা-ইমাম এবং সীমান্ত-পারের জেহাদিরাও জনসমাজে মিশিয়া নানা উস্কানি দেন। সীমান্ত বরাবর পাক সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের আড়ালে মুজফ্ফরাবাদে আশ্রিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লস্কর-এ-তইবার যোদ্ধারাও অনুপ্রবেশ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এমনিতেই কাশ্মীরের বহু মানুষের কাছে একটি দমনমূলক বাহিনী বলিয়া প্রতিভাত। সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহারের ফলে রাজ্যবাসীর কাছ হইতে তাহারা দখলদার বাহিনীর মতোই অসহযোগিতা ও বিরূপতা পাইয়া থাকে। এত নেতিবাচকতার মধ্যেও রাজ্যের নির্বাচিত সরপঞ্চরা কাজ করিতেছিলেন। জেহাদি সন্ত্রাসের বিকল্প হিসাবে গণতান্ত্রিক উন্নয়নের মডেলটি ধীরে-ধীরে মান্যতা পাইতে শুরু করিয়াছিল। কিন্তু তাঁহাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যথেষ্ট চেষ্টা রাষ্ট্রের তরফে হয় নাই। ফলে তৃণমূল স্তরের জনসাধারণের সহিত সরকার তথা শাসক দলের সংযোগসূত্রটিও বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে। এই অবস্থায় সীমান্তরেখা বরাবর সংঘর্ষ বা গুলিবিনিময় ও তাহার ভারতীয় প্রতিক্রিয়া কাশ্মীরের উত্তেজনা আরও বাড়াইয়া তুলিতে পারে। |