ক্লাবগুলির প্রতি রাজ্য সরকারের বদান্যতার সংবাদ দিল্লি অবধি পৌঁছাইয়াছে। যোজনা কমিশন ক্ষুব্ধ। কিন্তু রাজ্যবাসী বিস্মিত হইয়াছেন কি? তৃণমূল সরকার গোটা রাজ্য প্রশাসনই ‘অমুকসংঘ’ কিংবা ‘তমুকপল্লি’ চালাইবার ন্যায় চলিতেছে। কিঞ্চিৎ সমাজসেবা-সহ অঢেল ফুর্তি করিবার যে দীর্ঘ ঐতিহ্য রহিয়াছে শহর-গ্রামের ক্লাবের, সেই পথেই রাজ্য প্রশাসন চলিতেছে। তাহাতে পরিকল্পনা, যোজনা, বরাদ্দ-ব্যয়ে সামঞ্জস্য, আপাত-লক্ষ্য এবং আগামী-লক্ষ্য, এমন সব জটিল বিষয় হইতে মুক্তি মিলিয়াছে। প্রতিদিনই সংবর্ধনা, স্মরণ, পুরস্কার প্রদান, দিবস উদ্যাপনের আনন্দ মিলিতেছে। রাজ্য সরকার যখন ক্লাবকেই ‘আদর্শ প্রতিষ্ঠান’ বলিয়া নির্ধারিত করিয়াছে, তখন ক্লাবগুলিই যে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাইবে, ইহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। এই সকল ক্লাব খেলাধুলার চর্চা করিবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করিবে,পূজার আয়োজন করিবে, আবার পাড়ার মহিলাদের অভিভাবকত্বের দায়িত্বও তাহাদেরই। সমাজবীক্ষায় এমন অটল ‘অপরিবর্তন’ খুব কমই দেখা যায়। ইহার ফলে সেই পাড়া, সেই গ্রামের চিত্র আরও গভীর করিয়া খোদাই করা হইল, যেখানে সরকারি টাকায় ক্লাবঘরটি পাকা হইবে, সন্ধ্যার পর তাহাতে টি ভি চলিবে, ক্যারম খেলা চলিবে, কিন্তু স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সম্মুখে শিশু-কোলে মায়েদের জন্য একটি বেঞ্চ কিংবা শৌচাগারের ব্যবস্থা হইবে না। সমস্ত অনুন্নয়নের দায় কেন্দ্রের উপর চাপাইয়া, উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ রাজ্যের টাকা ক্লাবগুলিকে বিলাইবার মধ্যে সেই মানসিকতা কাজ করে, যাহার তাগিদে বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের অভুক্ত রাখিয়া পুরুষরা আকণ্ঠ মদ গিলিয়া আসে। ক্ষমতার লোভের মতো তীব্র মাদকতা আর কী হইতে পারে? তাহার বশে চরম বঞ্চনা, সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানহীনতাও ‘অন্যায়’ বলিয়া মনে হয় না। পরিস্থিতি যত ভয়ানক হয়, ততই তাহাকে অবধারিত, অবশ্যম্ভাবী বলিয়া মনে হইতে থাকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যাহা করিয়াছে, তাহার প্রতি পদেই অন্যায়, এবং অনিয়ম স্পষ্ট হইয়াছে।
প্রথমত, জনগণের টাকা তিনি সম্পূর্ণ পরিকল্পনাহীন ভাবে খরচ করিয়াছেন। যে টাকা ক্রীড়ার উন্নতির জন্য বরাদ্দ, তাহা তিনি ব্যয় করিয়াছেন এমন ভাবে যাহাতে ক্রীড়া পরিকাঠামো কিংবা প্রশিক্ষণে কোনও উন্নতি নিশ্চিত করিবার কোনও ইচ্ছাই নাই। যে রাজ্যে পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে, নিয়মিত রোজগারের অভাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের বহু ক্রীড়াবিদ খেলা ছাড়িতে বাধ্য হয়, সে রাজ্যে ক্লাবগুলিকে টাকা দিয়ে ক্রীড়ার উৎকর্ষ কী রূপে নিশ্চিত করা যাইবে? এই টাকা কি আগামী দিনের বন্দনা পাল, মামণি মণ্ডল বা রহিম নবির মতো ক্রীড়াবিদ তৈরি করিতে ব্যয় করা যাইত না?
দ্বিতীয়ত, ইহার নির্বাচনপ্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। বিধায়কদের সুপারিশ কেন ক্রীড়া উৎকর্ষের শর্ত হইবে? এই নির্বাচনে সরকারি সহায়তাকে রাজনীতিমুক্ত করিবার প্রচেষ্টার আভাসটুকুও নাই। তৃতীয়ত, আর্থিক অনুদানের এই ব্যবস্থা একান্ত অস্বচ্ছ। টাকা কী খাতে খরচ করা হইবে, সে বিষয়ে ক্লাবগুলির উপর কোনও শর্ত আরোপ করা হয় নাই। দুই হাজারেরও অধিক ক্লাব কী কাজে তাহাদের টাকা ব্যয় করিল, তাহার পরীক্ষা এবং পরিদর্শন কার্যত অসম্ভব। ফলত যে ঘর পাকা করিবে, যে পূজায় জাঁকজমক বাড়াইবে, এবং যে বাস্তবিক সমাজকল্যাণ এবং ক্রীড়ায় মনোনিবেশ করিবে, সরকারের চক্ষে তাহাদের মধ্যে কোনও ব্যবধান নাই। তাহাদের সকলের জন্যই অন্তত পাঁচ বৎসর নিয়মিত অনুদান বাঁধা রহিয়াছে।
এই অবস্থায় এমন কথা মনে করিবার বিলক্ষণ কারণ আছে যে, খুচরো রাজনৈতিক লাভই ক্লাবগুলির প্রতি এই বদান্যতার কারণ। অর্থাৎ সরকার কাহার জন্য, সেই প্রশ্নের যে উত্তর বাম আমলে মিলিয়াছিল, সেই উত্তর এখনও মিলিতেছে। ভয় দেখাইয়া ভোট আদায়ের উলটো পিঠ, লোভ দেখাইয়া ভোট আদায়। সেই হিসাব হয়তো মিলিয়া যাইবে, টাকা দিলে ভোট মিলিবে। কিন্তু যাঁহারা প্রাণ বাজি রাখিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় আনিয়াছিলেন, তাঁহারা কি পাঁচ বৎসরে ছয় লক্ষ টাকার আশাতেই ভোট দিয়াছিলেন? |