|
|
|
|
মানুষের পাগল বন্যা, হৃদযমুনা উছল ভারতের |
অগ্নি রায় • ইলাহাবাদ |
শীতের শেষ রাত এমনিতেই নদী চরাচরে কিছু রহস্য বুনে দেয়। তার সঙ্গে যদি যোগ করা যায় আদিগন্ত কুয়াশা, হাজার হাজার হলুদ হ্যালোজেন চমকানো বালুতট, বাতাসে অবিরল শঙ্খনাদ, ‘জুনা আখড়ার’ বিপজ্জনক নাগা সন্ন্যাসীদের অস্ত্র হাতে দৌড়...
বিশ্বের বৃহত্তম দৈব পিকনিকে জাদু এবং বাস্তবের তফাৎটা তখন ক্রমশই কমতে থাকে রাতের তাপাঙ্কের মতন।
সামনে কুহকের মতো অপেক্ষমাণ হিমশীতল ত্রিবেণী সঙ্গম। যেখানে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য ঝাঁপ দিতে চব্বিশ ঘণ্টা জেগে থাকল প্রয়াগ। যেখানে ডুব দেওয়ার তীব্র আবেগে একাকার হয়ে গেল ছেঁড়া ছাতা এবং রাজছত্র। পাগল বন্যার মতো মানবঢল এ কূল ও কূল ভাসিয়ে জানিয়ে দিল, ভারতের হৃদ্যমুনা উছল হওয়ার শুভসংবাদ।
উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের কড়া অনুশাসনে এ বার সঙ্গমের দশ কিলোমিটার আগে থেকে সমস্ত রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ। ফলে মধ্যরাত থেকেই পদব্রজের ঐতিহ্যে ফিরল প্রয়াগ। যে পথে বিজয়ী মৌর্যবাহিনী, মুগ্ধচিত্ত গ্রিক রাজদূত মেগাস্থেনিসের পদরেণু, অথবা সমুদ্রগুপ্তের রথের ঘড়ঘড়ানি, এ বার সে পথেই বাক্সপ্যাঁটরা, কম্বল, জল ভরার পাত্র, কোলে শিশু, মায় ল্যাপটপ নিয়ে মধ্যরাত থেকে পায়ে হেঁটে তীর্থযাত্রীদের ভিড়! হনুমান মন্দির থেকে প্রয়াগ ঘাটে যাওয়ার দীর্ঘ পথের দু’পাশে বেড়ার ধারে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে লাখো লাখো পুণ্যসন্ধানী এবং কৌতূহলীদের উপচে পড়া। কখন বেরোবে সাধুগ্রাম থেকে সেই আকাশ পাতাল এক করে দেওয়া শোভাযাত্রা? কখন দেখা যাবে দেশের বিভিন্ন আখড়ার থেকে আসা শ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসী মহামণ্ডলেশ্বরদের? |
|
সঙ্গমে স্নান পুণ্যার্থীদের। সোমবার ইলাহাবাদে। ছবি: এএফপি |
দেখা গেল কাঁটায় কাঁটায় ভোর সাড়ে পাঁচটার সময়। বিশাল বিশাল ট্রাকের উপরে রৌপ্যসিংহাসনে আগে পিছে বিপুল সংখ্যক সন্ন্যাসী আর ভক্ত নিয়ে শোভাযাত্রা গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর দিকে। আঠারোটি আখড়ার পরপর শোভাযাত্রা। প্রথমেই মহানির্বাণী আখড়ার চোখ ধাঁধানো জুলুস। যার প্যাটার্ন প্রথমে মহামণ্ডলেশ্বরের রৌপ্যরথ, তার পর সাধু মোহন্ত এবং শেষে নাগাবাহিনী। গগনবিদারি আওয়াজ, ‘ব্যোম ব্যোম ভোলে’ শোনার পরই সৈকতে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (যত ক্ষণ নাগাবাহিনী সঙ্গমসৈকতে খেলেছেন এই ‘বিশ্ব লয়ে’, নিরাপত্তী কর্মীর সতর্কতা ছিল টানটান) পজিশন নিয়েছেন। নদীর ধারেই হুমড়ি খেয়ে পড়া মিডিয়াকে বার বার সতর্ক করে বলা হয়েছে, “আপনারা দড়ির ও পারে যান। কোনও অঘটন ঘটে গেলে আমরা দায়ী থাকব না। এরা হিংস্ত্র। হাতের অস্ত্রে আহত হতে পারেন।”
মারদাঙ্গার জন্য কুখ্যাত জুনা আখড়ার শোভাযাত্রা নদীর কাছাকাছি আসার পর এই সাবধানতার বহর বেড়েছে অনেক গুণ। কারণও রয়েছে। শাহিস্নানে কে আগে অবগাহন করবে তাই নিয়ে শৈব এবং বৈষ্ণবদের রক্তপাতের ইতিহাস তিনশো বছরেরও বেশি পুরনো। আর শিবের সাধকদের মধ্যে সব চেয়ে ভয়ানক এই নাগারা। প্রাচীন যুগে এঁরাই ছিলেন ধর্মরক্ষক ফৌজ। আজও হাতে তলোয়ার, ত্রিশূল-সহ হরেক অস্ত্র। সঙ্গমের দিকে ভস্মটুকু সম্বল করে যে ভাবে দৌড়ে এলেন শয়ে শয়ে রক্তচক্ষু নাগা সাধু, মনে হওয়া স্বাভাবিক, তাঁদের ধর্ম বোধহয় আবারও সঙ্কটে!
কিন্তু প্রশাসনের রক্তচাপ কমিয়ে বিভিন্ন আখড়ার নাগারা খেলতে থাকলেন নিজেদের মধ্যেই। স্নান সেরে উঠে এবং ডুব দেওয়ার পরে চক্রাকারে ঘুরতে লাগল রকমারি ছিলিম। বড় তামাকের গন্ধে ম ম করছে চরাচর! একে অন্যের পা ধরে টেনে ফেলে দেওয়া, হঠাৎই ভূমিশয্যা থেকে উঠে ঘাড়ে লাফিয়ে ওঠা, দু’তিন ফুট লম্বা জটা ধরে বনবন করে ঘোরানো, সবই তাঁরা করলেন দেশি ও বিদেশি মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে মসৃণ ভাবে। নাচলেন নিজস্ব নাচ। গলায় পরা গাঁদার মালা ছুড়তে থাকলেন আকাশে। বারো বছর পর এ বারের মহাকুম্ভে কি অনেকটাই প্রচার সচেতন হয়ে উঠেছেন ভস্মমাখা সর্বত্যাগীরাও! নিশ্চয়ই তাই, কেননা বেলজিয়ামের টিভি সাংবাদিক ক্যারোলিনের বুমের সামনে দাঁড়িয়ে ‘বাইট’ দিলেন এক উলঙ্গনাথ। বললেন, “এই স্নানের পর মনে আজ বড় আনন্দ। কেন আপনার মনে আনন্দ নেই? ব্যোম শঙ্কর।” এই ‘আনন্দের’ খোঁজে আজ অবশ্য সবাই এখানকার আকাশের নীচে একমত। তীর্থে বিপদের ঝুঁকি থাকেই, বিশেষত এমন তীর্থে যেখানে মানুষের সংখ্যা এক কোটি ছুঁতে চলেছে। মাইকে বার বার সাবধানবচন, বহু দুষ্কৃতী নাকি ভণ্ড সন্ন্যাসী সেজে ঢুকে পড়েছে, যার মধ্যে মহিলার সংখ্যাও অনেক! ডুব দিতে নামার অঙ্কে ভুল হলেই বিপদের সম্ভাবনা। কিন্তু হাড় হিম করা ঠান্ডায় সিক্ত বস্ত্রে নদী থেকে উঠে আসার পরই প্রত্যেকের মুখে লটারি জয়ের হাসি।
সন্ন্যাসীদের স্নানের জন্য পৃথক ব্যবস্থা, আম জনতার জন্য আলাদা। যাঁরা তাঁবুতে জায়গা পাননি বা অন্যত্র থাকার সুযোগ বা সংস্থান নেই (শাহি স্নানের জন্য গোটা দেশ থেকে আসা মানুষের চাপ আর নিতে পারছে না এখানকার হোটেল, ধর্মশালা), তাঁরা দেখলাম বালিতেই সংসার পেতে রয়েছেন গোটা রাত। বড় কম্বল পেতে সুটকেস সাজিয়ে চাদর দিয়ে ঘিরে গড়েছেন অস্থায়ী শিবির। এ রকম একটি পরিবার বর্ধমানের বিশ্বরঞ্জন গুহের। স্ত্রী এবং যৌথ পরিবারের অন্য সবাই ভোলানন্দগিরি আশ্রমে দীক্ষিত। ছোটখাটো ব্যবসা করেন ভাইয়েরা মিলে। শীতের মধ্যে খোলা আকাশের তলায় রাত জাগার ক্লান্তি কাটালেন সঙ্গে ‘ডুবকি’ লাগিয়ে। মেলা ছাড়ার আগে বললেন, “এখানে না এলে এই আনন্দ উপলব্ধি করা যেত না। ভারতের ঐতিহ্যের সঙ্গে যেন জুড়ে গেলাম। এই আমাদের প্রথম কুম্ভ দর্শন।” এই আনন্দ বুকে নিয়েই কুম্ভ প্রস্তুত হচ্ছে পরবর্তী শাহিস্নানের জন্য। |
|
|
|
|
|