|
|
|
|
ট্রেন চালানোই কাজ, বলছেন অধীর |
দেদার খরচে রাশ, নাচগানও বন্ধ রেলের সভায় |
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
ভাঁড়ারের হাল ফেরাতে এ বার অপ্রয়োজনীয় খরচে লাগাম পরাচ্ছে ভারতীয় রেল। এ জন্য যেমন অলাভজনক রুট বাতিলের কথা ভাবা হচ্ছে, তেমন রেলের অনুষ্ঠানে ‘বিনোদন’ পরিবেশনের রেওয়াজেও দাঁড়ি পড়তে চলেছে। এবং রেলের আসল কাজ যে ট্রেন চালানো সেই আপ্তবাক্য মাথায় রেখেই কোমর বাঁধছেন কর্তারা।
দিন দিন খরচ বাড়লেও যাত্রী-ভাড়া বাড়ানো যাবে না দীর্ঘলালিত এই জনপ্রিয় নীতির মাসুল দিতে গিয়ে ঘাটতির বিপুল বোঝা রেলের ঘাড়ে চেপে বসেছে। তবে এত দিনে বৃত্তটি থেকে বেরিয়ে আসার একটা প্রয়াস চোখে পড়েছে। যেমন, সম্প্রতি ট্রেন-ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল মন্ত্রক, গত দশ বছরে প্রথম। আগামী বাজেটে কলকাতা মেট্রো রেলের ভাড়া বাড়বে এমন ইঙ্গিত মজুত। আগামী রেল বাজেটে আয়বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও কিছু ‘কঠোর’ পদক্ষেপের আভাসও দিয়ে রেখেছেন রেল-কর্তারা।
কমানো হচ্ছে বাহুল্যের ব্যয়। প্রথমেই কোপ পড়ছে বিবিধ প্রচার অনুষ্ঠান, রঙিন বিজ্ঞাপন এবং বিনোদনের উপরে। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী জানিয়েছেন, “রেলের খরচে নাচগানের অনুষ্ঠান আর হবে না। রঙিন বিজ্ঞাপনেও রাশ টানা হচ্ছে।” উল্লেখ্য, ২০০৯ থেকে প্রায় তিন বছর রেল মন্ত্রক ছিল তৃণমূলের হাতে। রেলভবনের খবর, তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রেলের বহু অনুষ্ঠানে
তাঁর ঘনিষ্ঠ শিল্পী-বিশিষ্টদের ডাকাটা নিয়মে দাঁড়িয়েছিল। মঞ্চে নৃত্য-গীত পরিবেশিত হত। অনেক সময়ে দূর সঞ্চারে (রিমোট কন্ট্রোলে) দূর-দূরান্তে প্রকল্পের উদ্বোধন করতেন মন্ত্রী। ফলে প্রতিটি অনুষ্ঠানের পিছনে প্রচুর টাকা বেরিয়ে যেত, যা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছিল। অধীরবাবু এ দিন নাম না-করে সেই প্রসঙ্গটিই টেনে এনেছেন বলে রেল-কর্তাদের একাংশের দাবি।
একই সঙ্গে রেল-বহির্ভূত প্রকল্পেও খরচ নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত দিয়েছেন অধীরবাবু। এবং এখানেও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে তৃণমূল জমানার কিছু সিদ্ধান্ত। মমতা রেলমন্ত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের জন্য নতুন নতুন ট্রেন যেমন চালু করেছিলেন, তেমন গুচ্ছ গুচ্ছ প্রকল্পও ঘোষণা করেছিলেন, যার বেশ কয়েকটির সঙ্গে রেলের সরাসরি সম্পর্ক নেই। যেমন রেলের জমিতে শপিং মল, যৌথ উদ্যোগের (পিপিপি মডেলে) হাসপাতাল বা স্টেডিয়াম নির্মাণ। রেল-কর্তাদের দাবি: বাস্তব পরিস্থিতিতে এগুলোর রূপায়ণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেটা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন অধীরবাবু “এ বার রেল শুধু ট্রেন-ই চালাবে। শপিং মল বা পিপিপি মডেলে হাসপাতাল করবে না। রেল মন্ত্রক রেল-পরিষেবা দেওয়ার উপরেই নজর দেবে।”
একই ভাবে বন্ধ হতে পারে অলাভজনক কিছু ট্রেনও। আশানুরূপ যাত্রী হচ্ছে না এমন কিছু ট্রেন তুলে দিয়ে বেশি চাহিদার ট্রেনের কথা ভাবা হচ্ছে। যেমন হাওড়া-পুরী, অমৃতসর-চণ্ডীগড় ও দিল্লি-অজমের দুরন্ত এক্সপ্রেস উঠিয়ে ওই রুটে শতাব্দী, ইন্টারসিটি ও জনশতাব্দী এক্সপ্রেস চালানো হবে। কেন?
রেল বোর্ডের ব্যাখ্যা: সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দুরন্ত মাঝপথে থামে না বলে তেমন যাত্রী হচ্ছে না। দেশে মোট ৩৩ জোড়া দুরন্ত চলাচল করছে। অন্য যে সব দুরন্তে যাত্রী কম হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত নেবে রেল বোর্ড।
কিন্তু দুরন্ত এক্সপ্রেস ছিল মমতার মস্তিষ্কপ্রসূত। ট্রেনের গায়ে যে বাহারি রঙের ছবি, তা-ও তৃণমূলনেত্রীর আঁকা। সেই ট্রেন তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যে রাজনৈতিক মাত্রা পেয়ে যেতে পারে, সেটাও রেল-কর্তাদের মাথায় আছে। তাঁদের বক্তব্য: দুরন্ত উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিষয়টিকে এ ভাবে দেখা অনুচিত। শতাব্দী-ইন্টারসিটি’তে মাঝপথেও যাত্রীরা ওঠা-নামা করতে পারবেন। এতে যাত্রী বাড়বে, রেলের আয় বাড়বে। যাত্রীদেরও সুবিধা হবে।
এ প্রসঙ্গেই হাওড়া-পুরী দুরন্তের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন রেল বোর্ডের এক সদস্য। “সময়সূচির কারণে এবং রুটে অন্য বেশ কিছু ট্রেন থাকায় ওই ট্রেনটিতে সাধারণত আশানুরূপ যাত্রী হয় না। এমনিতেই কটক, ভুবনেশ্বরগামী যাত্রীরা এর সুবিধা পান না। উপরন্তু ধৌলি এক্সপ্রেসকে পুরী পর্যন্ত চালানোয় যাত্রী আরও কমেছে।” বলেন তিনি। রেল বোর্ডের প্রাক্তন কর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুরের কথায়, “রক্ষণাবেক্ষণের খাতিরে দুরন্ত যেখানে-যেখানে থামে (অপারেশনাল স্টপ), সেখানে যাত্রীরা ওঠা-নামার সুযোগ পেলেও রেলের আয় বাড়বে।” তা হলে এত দিন অলাভজনক দুরন্তগুলোকে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কেন? প্রশ্ন করা হলে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায় মন্তব্য করতে রাজি হননি।
শুধু দুরন্ত নয়। আসানসোল-হলদিয়া এক্সপ্রেস কিংবা হাওড়া-ধানবাদ ডবলডেকারের মতো ট্রেন চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতাও যাচাই করা হচ্ছে। অধীরবাবু বলছেন, “অলাভজনক রুট ও যথেষ্ট পরিকাঠামো ছাড়া জবরদস্তি ট্রেন চালানোর মানে হয় না। তাতে লোকসানই বাড়বে। তবে সিদ্ধান্ত হবে যাত্রীদের কথা মাথায় রেখে।” রেল-সূত্রের খবর: নতুন ট্রেন চালুর আগে যাত্রী-সুরক্ষার স্বার্থেই পরিকাঠামো ভাল ভাবে খতিয়ে দেখার সুপারিশ করেছিল কাকোদকর কমিটি। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার’ দরুণ তা মানা যায়নি। |
|
|
|
|
|