শুরুতেই হোঁচট! প্রতিশ্রুতি মতো আজ, মঙ্গলবার হলদিয়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’-এর মঞ্চ থেকে রাজ্যের নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করতে পারছেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মহাকরণের খবর, বিভিন্ন বণিকসভা এবং রাজ্যের শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সৌগত রায় শিল্পনীতির যে খসড়া জমা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে, তা চূড়ান্ত করে ওঠা যায়নি। তাই ‘বেঙ্গল লিডস’-এ লগ্নিকারীদের সামনে শিল্প নিয়ে দিশানির্দেশ তুলে ধরতে পারছে না রাজ্য। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সোমবার বলেন, “বিভিন্ন সূত্র থেকে যে সব প্রস্তাব এসেছে, সেগুলি খতিয়ে দেখে শিল্পনীতি চূড়ান্ত করতে সময় লাগবে। তাই ‘বেঙ্গল লিডস’-এর মঞ্চ থেকে নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করা হচ্ছে না। এ কথা আমরা লগ্নিকারীদের জানিয়ে দেব।”
মমতা সরকারের বিরুদ্ধে শিল্পমহলের অভিযোগ মূলত দু’টি। প্রথমটি জমি সংক্রান্ত। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে সরকারের তীব্র অনীহা এবং জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন বাতিল না-করার সিদ্ধান্ত লগ্নিকারীদের হতাশ করেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) গড়ার ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি। দ্বিতীয় অভিযোগ, শিল্পায়নের ব্যাপারে রাজ্যের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের কোনও চেষ্টাই না-করা। গুজরাত, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্য যখন লগ্নি টানতে আগ্রাসী, তখন পশ্চিমবঙ্গের তরফে প্রায় কোনও উদ্যোগই চোখে পড়ে না। মূলত এই দু’টি কারণেই গত দেড় বছরে রাজ্যে কোনও বড় বিনিয়োগের প্রস্তাব আসেনি।
এই অবস্থায় কয়েক মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী যখন নতুন শিল্পনীতি তৈরি করার কথা ঘোষণা করেছিলেন, তখন খানিকটা হলেও আশায় বুক বেঁধেছিল শিল্পমহল। মনে করা হচ্ছিল, তাদের দাবিদাওয়ার কিছু সদুত্তর এই শিল্পনীতিতে মিলবে। বস্তুত, শিল্পনীতি নিয়ে বণিকসভাগুলির কাছ থেকে মতামতও জানতে চেয়েছিল রাজ্য সরকার। গত ৮ জানুয়ারি সকলের মতামত সম্বলিত শিল্পনীতির খসড়া মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের হাতে তুলে দেন খসড়া তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়।
পরের দিনই মহাকরণে শিল্পমন্ত্রী জানিয়ে দেন, মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছেমতো ১৫ জানুয়ারি ‘বেঙ্গল লিডস’-এর মঞ্চে নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা হবে। তিনি বলেন, “বণিকসভাগুলি শিল্পনীতি নিয়ে মতামত জানিয়েছে। নির্দিষ্ট খসড়া তৈরি করেছে মুখ্যমন্ত্রীর গড়ে দেওয়া মন্ত্রিগোষ্ঠীও। সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখেই চূড়ান্ত শিল্পনীতি তৈরি হবে।” এর পরেই শিল্প নিয়ে রাজ্যের সার্বিক ভাবনা জানার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করছিল শিল্পমহল।
|
‘গন্তব্য হলদিয়া’
|
শিরোনামে আজ শুরু হচ্ছে বেঙ্গল লিডস ২।
ঘটনাক্রম অবশ্য বলছে,
শিল্প মানচিত্রে ক্রমেই ম্লান হচ্ছে হলদিয়া। রাজনৈতিক দাদাগিরিতে শিকেয় শিল্পের পরিবেশ। |
• তৃণমূলের জঙ্গি আন্দোলন ও সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে দায়ী করে বন্দর ছেড়েছে এবিজি।
• জমি অধিগ্রহণে হাত তুলেছে রাজ্য সরকার। বিপদের ঘণ্টা সিইএসসি-র বিদ্যুৎ প্রকল্পে।
• উদ্বোধনের বছর পার। চালু হল না কলকাতা থেকে হলদিয়া হেলিকপ্টার পরিষেবা। • তৃণমূল রেল দফতর ছাড়ার পরে জেলিংহ্যামে রেল যন্ত্রাংশের কারখানা অথৈ জলে।
• শালুকখালিতে পিপিপি মডেলে বন্দর ২ প্রকল্পের কাজ এগোয়নি একচুল।
• পরিবেশ দফতরের ছাড়পত্র না-পেয়ে নয়াচরে ‘পরিবেশ বান্ধব’ প্রকল্প বিশ বাঁও জলে। |
|
|
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছে, পার্থবাবুর ঘোষণা, শিল্পমহলের প্রতীক্ষা কোনওটাই কাজে আসছে না। সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, “সব কিছু গুছিয়ে উঠতে সময় লাগছে। নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করতে আরও দিন পনেরো সময় লাগতে পারে।” তা হলে শিল্পমন্ত্রী এমন ঘোষণা করলেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই সৌগতবাবুর। বরং খসড়া জমা পড়ার সাত দিনের মধ্যে চূড়ান্ত শিল্পনীতি তৈরি হতে পারে না বলেই মনে করেন তিনি। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, “শিল্পনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা ছাড়া বণিকসভাগুলি আর্জি জানিয়েছে, খসড়া চূড়ান্ত করে তা ওয়েবসাইটে মতামতের জন্য তুলে দেওয়া হোক। আমার মনে হয় না, এত তাড়াতাড়ি তা চূড়ান্ত করা সম্ভব।” হলদিয়ায় শিল্পনীতি ঘোষণা হচ্ছে না জেনে বণিকমহলের অনেকেই হতাশ। পার্থবাবু অবশ্য এই নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি।
তা হলে ‘বেঙ্গল লিডস’-এর আসরে সরকারের বক্তব্য কী হবে? মহাকরণের খবর, যে সব ঘোষণা ইতিমধ্যে করে ফেলা হয়েছে, যেমন, জমি অধিগ্রহণ এবং এসইজেড নীতি, যৌথ উদ্যোগ ও জমি বিলি সংক্রান্ত নীতি, ভূমি আইনের ১৪ওয়াই ধারায় শিল্পের জন্য অতিরিক্ত জমি রাখার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া, তথ্যপ্রযুক্তি নীতি ইত্যাদি, সেগুলিই আর এক বার জানাবেন মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী। সরকার যে শিল্পের জন্য একটি ‘অনুদান প্রকল্প নীতি’ তৈরি করছে, তা-ও জানানো হবে। এই নীতিতে কোনও লগ্নিকারী সংস্থা ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’ হিসেবে স্কুল-কলেজ-হাসপাতালের মতো পরিকাঠামো তৈরি করলে বিশেষ অনুদান পাবে। পাশাপাশি, রাজ্য চায়, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে শিল্প পার্ক তৈরি হোক। এ ক্ষেত্রে সরকার যে বিশেষ ভাবে সাহায্য করবে, সেই বার্তাও দিতে চাইবেন মমতা-পার্থ।
তবে বড় শিল্প আসছে না দেখেও শিল্পনীতিতে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত অবস্থান পরিবর্তন করা হবে না বলেই মহাকরণ সূত্রের খবর। এমনকী এসইজেড নীতিতে বদল হওয়ার সম্ভাবনাও প্রায় নেই। ইনফোসিস রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেও। যদিও তাঁর পেশ করা খসড়ায় এসইজেডের একটি বিকল্প প্রস্তাব রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সৌগতবাবু। যাতে বলা হয়েছে, সরকার ‘করমুক্ত এলাকা’ তৈরি করতে পারে, যেখানে শ্রমিকদের অধিকার অটুট রেখে এসইজেডের মতোই আর্থিক সুবিধা দেবে রাজ্য। সৌগতবাবু জানান, এসইজেড-এ সব মিলিয়ে ১৮% কর ছাড় দেওয়া হয়। রাজ্য সেই আর্থিক সুবিধা দিতে পারে। একটি বণিকসভাই এই প্রস্তাব দিয়েছে বলে তিনি জানান। |