রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
জাস্ট যাচ্ছি
ক্যাসেট প্লেয়ারটা অ্যাশলিনের। বড়সড়। স্টিরিয়ো। অনেকগুলো সুইচ, স্লাইডার আছে। কোনওটাই কাজ করে না। শুধু ক্যাসেট ভরে প্লে-বোতামটা চেপে ধরলে একটু পরে চলতে শুরু করে আস্তে আস্তে। ক্ষীণ আওয়াজও শোনা যায়। গান, বাজনা। চার পাশে এত অন্ধকার, এত চুপচাপ যে ভল্যুমের নব-টা ঘোরানোর দরকার পড়ে না। অন্ধকারের একটা আলো থাকে। ওতেই দেখা যায় পাহাড়ের মাথা, কালো আকাশের গায়ে। আর কিছু দেখার মতো নেই এখানে। ফাঁকা জায়গা, গাছপালা, পাথর। একটা স্কুল, এখানেই আমি পড়াই। অ্যাশলিন-ও তাই। এ ছাড়া আর একটা টিনের চালওয়ালা একতলা বাড়ি আছে, ওখানেই থাকি আমরা। আলাদা আলাদা ঘরে। পড়ানো ছাড়া আর বিশেষ কোনও কাজ না থাকার দরুন কিছুই করতে ভাল লাগে না। হ্যারিকেনের কাচটাও মুছি না। তার কালি পড়ে যাওয়া কাচের মধ্যে দিয়ে অল্প আলো এসে পড়ে ক্যাসেট প্লেয়ারটার ওপর। দেখা যায় স্পুল দুটো ঘুরছে। ভয় লাগে।
জায়গাটার নাম নোরবুলিং। ম্যাপে নেই বোধ হয়। গালেফু থেকে হেঁটে তিন ঘণ্টা লাগে। গালেফু-র নাম পাওয়া যাবে ভুটানের ম্যাপ দেখলে। ওখানে ইলেকট্রিসিটি আছে। সপ্তাহে এক বার যাই ওখানে। ইলেকট্রিকের আলোয় লোকজন, রাস্তা, ট্রাক এ সব দেখতে। অ্যাশলিনও আসে। নোরবুলিং ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় অনেক সময়।
সন্ধে হয়ে গেলে আমরা মাঝেমধ্যে একটু দূরে গিয়ে বসি। কথা হয় একটা-দুটো। গালেফু থেকে কেনা চাইনিজ ব্যাটারিতে চলে টেপ রেকর্ডারটা, বেশি দিন চলে না। তাই মাঝে মাঝে ওটাকে নিয়ে যাই সঙ্গে করে। পিয়ানোর ক্যাসেট আছে একটা, ওটাই বেশি শুনি। জর্জ উইনস্টনের ‘ডিসেম্বর’।
ভুটানের প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়ানোর চাকরিটা নিয়ে নিই মাইনেটা ভাল বলে। মতলব, কয়েক বছর পরে অনেকটা টাকা জমলে কলকাতায় ফিরে কিছু করা যাবে। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন থেকে অ্যাশলিন কেন এসেছিল সেটা জিজ্ঞেস করার সময় পাইনি এক বছরে। ওখানে ওর বাবা বাড়ির পিছনের বাগানে গাঁজার চাষ করেন। আমরা সেই গাঁজা খাই মাঝে মাঝে নোরবুলিং-এ বসে। গান চলে, কথা বলি না বিশেষ।
গ্রামে যতগুলো বাড়ি, তার চেয়ে কিছু কম সংখ্যার শুঁড়িখানা। ওখানে টংবা খাই। নেপালে বলে জাড়। যব পচিয়ে মদ তৈরি করে এরা। বাঁশের পাইপ দিয়ে টেনে খেতে হয়। দিয়ে যায় ছেকি, মালিকের মেয়ে। ষোলো-সতেরো হবে নিশ্চয়ই। পড়ে আমাদেরই স্কুলে, ক্লাস টু-তে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় রাউন্ড দেবার সময় অনেক সময় গা-য়ে গা ঠেকে যায় অন্ধকারে। বুঝতে পারি। ভাল লাগে।
ছবি: শুভময় মিত্র
ছেকির ছবি তুলেছি একটা, লুকিয়ে। কেউ দেখে ফেললে মুশকিল হবে। কিন্তু নেগেটিভ বানিয়ে প্রিন্ট করতে হবে। এক কপি আমার, এক কপি ছেকির। ‘ডিসেম্বর’ ক্যাসেটটার একটা কপিও করা দরকার। এক জনই রাতারাতি সেটা করে দেবে এবং কাউকে বলে দেবে না। সে হল সিদ্ধার্থ। ছবি তোলে, গান-টান শোনে, নোংরা জামাকাপড় পরে। যখন-তখন যাওয়া যায় সিদ্ধার্থর বাড়িতে। প্রায় দু’দিন ধরে হেঁটে, বাস-ট্রেন বদলে এসেছি ওর বাড়িতে। অনেক রাত হয়ে গেছে। ডাকলাম। ঘরের ভেতর স্টিরিয়ো চলছিল, বন্ধ হল। দরজা খুলল ‘আয়’।
সিদ্ধার্থর একটা বড় সুবিধে হল, কখনও কোনও প্রশ্ন করে না। বলল, ‘ক্যাসেটটা চাপিয়ে দিই, ডুপ্লিকেট হতে হতে ফিল্ম প্রসেস করে ফেলব, তার পর প্রিন্ট। দুটো হাফ-সাইজ তো? খাবি কিছু?’ ডার্করুমে অন্ধকারে কোনও কথা বলছিলাম না আমরা। খালি বললাম, ‘ক্যাসেটটা অ্যাশলিনের, ছবিটা ছেকির।’ সিদ্ধার্থ কিছু বলল না, জিজ্ঞেসও করল না নোরবুলিং-এর কথা। জলের শব্দ হচ্ছিল। ডার্করুমের বাইরে থেকে ডিসেম্বর-এর টুংটাং শুনতে পাচ্ছিলাম। এক টেপ থেকে অন্য টেপে ছবি হয়ে যাচ্ছে ডিসেম্বর। অ্যাশলিনের ডিসেম্বর-এর থেকে আমার ডিসেম্বরে ঠান্ডা বেশি হবে, সে ভাবেই অ্যাডজাস্ট করে রেকর্ডিং করছে সিদ্ধার্থ। কথা শুনে তাই মনে হল।
ডার্করুমের লাল আলোয় প্লাস্টিকের ট্রে-তে টক-টক গন্ধওয়ালা জলের মধ্যে ছেকির ছবিটা নিয়ে খেলা করছিল সিদ্ধার্থ। এই রকম গন্ধ নোরবুলিং-এ ছেকির গায়েও পেয়েছি। অ্যাশলিনের গন্ধ অন্য রকম। উগ্র নয়। শেষ পর্যন্ত সাদা জলে চান করিয়ে ছেকিকে আলতো করে তুলে নিল সিদ্ধার্থ। ভিজে অবস্থায় পেতে দিল আমার হাতে। সারা গা থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে, জমা হচ্ছে আমার হাতের তালুতে। সিদ্ধার্থ অদ্ভুত একটা হাসি মুখে ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিছুই বলছে না। হাবভাব উঁচু বেদির ওপর পাথরের মূর্তির মতো। ও-দিকে ডিসেম্বর ফুরিয়ে আসছে বুঝতে পারছি। ডার্করুম থেকে বেরোতে বেরোতে সিদ্ধার্থ শুধু জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাশলিনের কোনও ছবি নেই?’ আমি বললাম, ‘খিদে পেয়ে গেছে, দে কিছু একটা।’
অ্যাশলিনের দেওয়া গাঁজা খেলাম, সিদ্ধার্থও নিল। ওর খাটে পাশাপাশি শুয়ে সিলিং-এর দিকে ধোঁয়া ছাড়ছিলাম। কথাবার্তা তেমন হচ্ছিল না, কিন্তু আমি জানি যে ও অনেক কিছু ভাবছিল। অনেক ব্যাপারে মাথা আছে ওর, প্রশ্নগুলো গুছিয়ে রাখছে, পরে করবে। হয়তো সকালে। চা খেয়েই বেরিয়ে পড়ব। নিজের বাড়ি যাব না। যাবার কোনও কারণ নেই, কেউ জানেও না কোথায় ছিলাম, কোথায় আছি, কোথায় যাব এর পরে। সত্যি বলতে কি, আমিও জানতাম না।
ডুপ্লিকেট ক্যাসেটটা দেখতে পাচ্ছি, আসলটার বাক্সর ওপরেই রাখা আছে ক্যাসেট ডেক-এর পাশে। ছেকির ছবিটা ঝুলছে, ক্লিপে লাগানো অবস্থায়। সব জল ঝরে গেছে ছেকির গা থেকে। শুকনো হয়ে গেছে শরীর, অথচ ছবিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে সে চান করছে। উঠে গিয়ে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিলাম।
ঘর অন্ধকার হতেই মনে হল এটা নোরবুলিং। অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতেই নিজেদের ভাঁজ করা পা আর হাঁটু দেখে মনে হল চেনা পাহাড়ের আউটলাইন। হাওয়ায় ছবিটা এ-দিক ও-দিক ঘুরছিল। জানলা দিয়ে আসা আলোয় মাঝে মাঝে চকচক করছিল তারার মতো। ঘরের এক পাশের দেওয়ালে বই-ঠাসা র্যাক দেখে মনে হল তরাই-এর জঙ্গল, কিছুটা দূরে। কিন্তু আমার পাশে কে? লাল সিগনালটা কীসের? দিগন্তে স্পন্দন কেন? আর একটা সিগারেট ধরিয়েছে সিদ্ধার্থ। চোখ নিশ্চয়ই বন্ধ।
আমার ঘুম আসছিল না। একেবারে নড়াচড়া না করে চোখের পাতা খুলছিলাম। নজর রাখছিলাম আলগোছে পাক-খাওয়া ছেকির ছায়াটার দিকে। আর এক পাশে সিদ্ধার্থর দিকে। এক সময় মনে হল থেমে গেছে হাওয়া, থেমে গেছে সব নড়াচড়া।
ঘুমিয়ে পড়েছে ছেকি, চান করতে করতে। ঘুমিয়ে পড়েছে সিদ্ধার্থ।
এতটুকু শব্দ না করে পা নামালাম মাটিতে। উঠে দাঁড়ালাম। দুটো ক্যাসেট পকেটে পুরলাম সাবধানে। চটিতে পা লাগালাম, ছোট ব্যাগটা তুলে নিলাম। ভোর হতে দেরি আছে অনেক।
হালকা করে দরজা খুলে নিজেকে বার করে আনলাম বাইরে। এক বার তাকালাম ছবিটার দিকে। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। স্থির হয়েই আছে, যেন অপেক্ষা করছে আমি নেব বলে।
মুখ ঘুরিয়ে নিলাম, চোয়াল শক্ত করে। নেব না ওকে। থাক। পড়ে থাক ছেকি, সিদ্ধার্থর কাছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.