মিস্টার ন্যাব
ড়সড় নাকওলা মিস্টার ন্যাব-কে বোর্ডিং হাউসের ছাত্রেরা খুবই শ্রদ্ধা করত। বোর্ডিং হাউসটির মালকিন ছিলেন খুব বুড়ি। তাঁর এক বিধবা মেয়ে ছিল। মেয়েটির বয়স এখন ছাব্বিশ, মিস্টার ন্যাব-এর সঙ্গে তার প্রেম। সম্পর্কটা অনেক দিন ধরে চলছিল। ন্যাব বহু দিন আগেই ডাক্তারি পরীক্ষা পাশ করে গিয়েছিলেন, কিন্তু মেয়েটার জন্য বোর্ডিং হাউসেই থেকে যান। তার পর হঠাৎই, ন্যাব ওই ছোটখাটো মেয়েটির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। করিডরে সবুজ রেশমি পেটিকোটের খসখস আওয়াজ কিংবা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ছোট-ছোট দু’টি পায়ের উচ্ছল পদসঞ্চার, এ সবে আর পুলকিত বোধ করতেন না।
সন্ধে সাড়ে সাতটায় ঘণ্টা বেজে ওঠা মানেই রাতের খাবার দেওয়া হয়েছে। এক চমৎকার সন্ধ্যায়, সবাই এসে পড়ল টেবিলে, কিন্তু অল্পবয়সি জার্মান ছেলেটির চেয়ার ফাঁকা। গরম কিন্তু বিস্বাদ স্যুপ দেওয়া হয়ে গেল, তখনও ছেলেটা সিটে এসে বসল না। মেয়েটি তাকাল ন্যাবের দিকে। ‘ও কেন খেতে আসছে না?’ ন্যাব বললেন, ‘মাত্র কয়েক সপ্তাহ হল এসেছে, হোম সিকনেস...’ সুশ্রী মেয়েটি নিষ্প্রাণ চোখে তাকাল ন্যাবের দিকে, ‘কান্নাকাটি করলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নীচে নিয়ে আসুন।’ ন্যাব ন্যাপকিনটা নামিয়ে রেখে উঠে গেলেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে জীবনের প্রতি ঘেন্না ধরে গেল তাঁর। এখন তিনি এই গেরস্থালিরই এক জন হয়ে উঠেছেন; এরা তাঁকে পাঠাচ্ছে জার্মান ছেলেটার খোঁজে। কিছু দিন আগেও ব্যাপারটা প্রেম-ভালবাসা ছিল... যেমনটা নাকি এক সময় প্রতিটা নোংরা, খারাপ, নিরানন্দময়, জঘন্য সম্পর্কই ছিল প্রেম। আর এখন, সেই অতীত প্রেমের দায় বহন করতে তাঁকে জার্মান ছেলেটার ভিজে নাকখানা মুছতে হবে গিয়ে। ‘আমার এই নষ্ট জীবনটা ওই শয়তানটা পেলে ভাল হত’, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ন্যাব ভাবলেন, ‘ওটাকে মজা দেখাব আমি...’
চার তলায়, কার্টের ঘরের চাবির ফুটো দিয়ে উঁকি মারলেন, কিন্তু সেটা রুমাল দিয়ে চাপা বলে কিছু দেখা গেল না। দরজায় টোকা দিলেন, ‘দয়া করে দরজা খোলো।’ সাড়া নেই। ঘরটার মধ্যে বোধহয় একখানা চেয়ার সজোরে ভেঙে পড়ল। ‘শুনতে পাচ্ছ?’ চিৎকার করে বললেন ন্যাব। ‘দরজা না খুললে দরজা ভেঙে ফেলব আমি। ভেতরে কী করছ তুমি?’ চাবিটা ঘুরল এবং দরজাটা খুলল। চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে কার্ট, মৃত্যুর মতো পাণ্ডুর। তার হাত-দুটো কাঁপছিল। ন্যাব লক্ষ করলেন, একটা দড়ি ঝুলছে, উপর দিকটা বিমে বাঁধা, নীচে ফাঁস তৈরি করা। ন্যাব ছেলেটার হাত জোরে চেপে ধরে বললেন, ‘বাড়ির জন্য ছটফট করছ?’ চশমা-পরা ছেলেটি কাঁদতে শুরু করল। ‘না’, সে ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘মিস্টার ন্যাব, আমি মরতে চেয়েছিলাম শুধু ভালবাসার জন্য।’ ‘কার প্রেমে পড়েছ? চোখের জলের ভেতর দিয়ে ছেলেটির মুখ দীপ্ত হয়ে উঠল। চশমা খুলে সেটা মুছে নিল, কাঁদল, হাসল, চোখ-দুটো বন্ধ করল এবং বিভ্রান্ত ছোট পাখির মতন মাথাটি ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি ওই ছোটখাটো মেয়েটার প্রেমে পড়েছি ওই বিধবা মেয়েটি, বোর্ডিং-এর মালকিনের মেয়েটা অপূর্ব সুন্দরী সেই মেয়েটার সরসর আওয়াজ-তোলা পেটিকোট কী সুন্দর গন্ধ তার, মেয়েটা এত চমৎকার!’
‘বেশ’, ন্যাব বললেন, ‘তার পর...?’
‘তার পর, সে ছাব্বিশ, আর আমি মাত্র ষোলো, আর সে বেশ গোলগাল, সুন্দরী পূর্ণবিকশিত মেয়েছেলে, আর আমি একটা অল্পবয়েসি ছেলে অর্ধেক পরিণত, গোঁফও গজায়নি, হাতগুলোও নরমসরম... আর আমি জানি যে এখনও আমি পুরুষমানুষ হয়ে উঠিনি। এবং এটাও জানি, সে চায় এক জন আসল পুরুষ... পুরুষের মতো পুরুষ।’
‘পুরুষের মতো পুরুষ?’ ন্যাব পুনরাবৃত্তি করলেন।
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
‘বুঝতে পারছেন, আমি চাইছি আমার চওড়া কাঁধ হোক, রোদে পোড়া তামাটে রং। ভাব দেখাব যেন মেয়েটার প্রতি আমার আগ্রহ নেই, মনে-মনে মেয়েটা আমার জন্য ছটফট করবে, কিন্তু সে সব তো হওয়ার নয়। আমি রোগা-পাতলা, চশমা-পরা, দেখতে মিষ্টি, এত নম্র-ভদ্র, কোনও সুন্দরী আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না, এমনকী আমার দিকে থুতুও ছেটাবে না।’
কার্ট প্রচণ্ড কান্নাকাটি শুরু করে দিল। ‘আমি আজ রাতেই মারা যাব। আমাকে বিদায় দিন, মিস্টার ন্যাব।’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে, কিন্তু একটু দাঁড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি।’ ‘মেয়েটাকে কিছু বলবেন না তো?’ এমন ভাবে কথাটা সে জিজ্ঞেস করল, যদি ন্যাব ‘না’ বলেন, তা হলে তার হৃদয় চুরমার হয়ে যাবে।
ন্যাব নীচে গিয়ে এক পাশে মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘কার্ট গলায় দড়ি দিতে যাচ্ছিল।’ ‘কেন?’ ‘সে তোমার প্রেমে পড়েছে। কান্নাকাটি করছে আর মরে যেতে চাইছে।’ মৃদু হাসল মেয়েটা, ‘দারুণ ব্যাপার।’ ‘হ্যাঁ’, ন্যাব মেয়েটার দিকে তাকালেন। এ মুহূর্তে তাকে অপূর্ব সুন্দরী লাগছিল, আত্মশ্লাঘা ও গুমোরে তার চোখ-দুটো জ্বলজ্বল করছিল, মুখ হয়ে উঠেছিল ভিজে-ভিজে ও লালচে। ন্যাব ফের বললেন, ‘হ্যাঁ’, এ বার তিনি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে অনুভব করলেন, তাঁর গলায় কিছু একটা আটকে আছে।
যাতে সবাই শুনতে পায়, ন্যাব চেঁচিয়ে বললেন, ‘চলো, ওপরে যাই তার কাছে।’ মেয়েটা তার ন্যাপকিনটা ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে গেল, ন্যাব পেছনে চললেন, কিন্তু মেয়েটা খুব জোরে হাঁটছিল। দু’জনে ঢুকল ছেলেটার ঘরে। ছেলেটা কাউচে শুয়ে ছিল, ওদেরকে দেখে লাফিয়ে উঠে পড়ল। প্রথমে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল, তার পর বিবর্ণ হয়ে উঠল তার মুখ। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে হাসল, মিষ্টি ও তোয়াজি ভঙ্গিতে বলল, ‘মিস্টার ন্যাব বললেন, তুমি নাকি বাড়ির জন্য মনখারাপে ভুগছ।’ ‘হ্যাঁ’, ছেলেটি বলল ও ন্যাবের বিচক্ষণতার জন্য তাঁর দিকে তাকাল কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে। ‘কষ্ট পেয়ো না’, ফিসফিস করে মেয়েটা এমন ভাবে বলল, যেন কোনও পরিণত-বয়স্ক মানুষকে বলছে, এবং তা-ও আবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে। ‘এখানে তোমাকে আমরা সবাই ভালবাসি। নাও, এ বার সামলে নাও।’
মেয়েটা ছেলেটির ছোট-ছোট ফুরফুরে চুলে হাত বুলোতে-বুলোতে তার মাথাটা টেনে নিল নিজের স্তনদ্বয়ের ওপর, চেপে। ছেলেটি চোখ বন্ধ করে পরিপূর্ণ মেয়েলি স্তনে সেঁটে থাকল। তার দেহভঙ্গি শিশুসুলভ হলে কী হবে, তার ঠোঁট-দুটো যেন পুড়ে যাচ্ছিল, ইচ্ছে করছিল কাঁদতে, হাসতে মেয়েটার ঠোঁটে চুমু খেতে, দুই হাতে মেয়েটার মাথাটা ধরতে এমন একটা ভয়ানক, দুর্ধর্ষ এবং পরিপূর্ণ প্রেম নিয়ে মেয়েটার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ-দুটোর দিকে তাকাতে, যে-প্রেম থাকে শুধুমাত্র এ ধরনের তরুণবয়েসিদেরই, যাদের মাথা এক জন খারাপ মেয়েছেলে মাতৃস্নেহে নিজের বিশাল স্তনে চেপে ধরে এক জন খারাপ, অজানা-অচেনা, উত্তপ্ত মেয়েছেলে, যে ফুটিয়ে তোলে রক্তকে।
ন্যাব ও মেয়েটি চলে গেল। ছেলেটা কাউচে ধপাস করে শুয়ে চোখ বন্ধ করল। সে ঠিক করল, এই বোর্ডিং-এ সে আট... কিংবা দশ বছর থাকবে, তার পর হয়তো মেয়েটি তার হয়ে যাবে। কেন মরবে সে, সে যখন ইতিমধ্যেই চুপি-চুপি তার স্তনে চুমু খেয়েছে? নিচে রাতের খাবার চলছিল: শেষ হলে সবাই যে-যার ঘরে চলে গেল, টেবিলে শুধু মেয়েটি আর ন্যাব। ন্যাব তাকালেন মেয়েটির দিকে এই মুহূর্তে তিনি মেয়েটির প্রতি অনীহা বোধ করছিলেন না। ওরা ড্রয়িং রুমে গেল; কেউ ছিল না সেখানে। দীর্ঘ ক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। মেয়েটি নিজের সামনে তাকিয়ে ছিল তার দীপ্ত গাল ও গোপন-সুখী হাসি নিয়ে। ন্যাব একটা সিগারেট ধরালেন। তিনি মেয়েটার দিকে তাকালেন, মেয়েটি তখন বলল, ‘ছেলেটা কিছু করবে না তো?’ ‘না’, বলেই ন্যাব সিগারেটটা ছুড়ে ফেললেন। মেয়েটির কাছে গিয়ে তার কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে তার চোখের দিকে তাকালেন। মেয়েটি শান্ত কণ্ঠস্বরে শুধোল, ‘তোমার মনে হয় না ছেলেটা কিছু একটা করে ফেলতে পারে?’ ‘না’ বলে ন্যাব মেয়েটার মুখে চুমু খেলেন। মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মুখে ন্যাবের মাথাটা চেপে ধরে একটা তৃপ্তির ভঙ্গি করল।
‘এ রকম একটা ছেলে... এ রকম... একটা... ছেলে...’
‘আরে না, না’, ন্যাব বললেন, ‘দড়িখানা এই যে আমার পকেটে।’ দড়িটা তিনি দেখালেন মেয়েটিকে, দু’জনেই হেসে উঠল। মেয়েটির চোখ তখন আধাবন্ধ। তার পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করে দু’জনেই ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ন্যাব একটা দীর্ঘ চুম্বন শেষ করেননি বলে চৌকাঠে দাঁড়াল দু’জন।
‘ওরা দেখে ফেলবে’, মেয়েটা বলল ফিসফিস করে, ‘এখানে চুমু খেয়ো না।’ সে দৌড়ে এগিয়ে গেল। ন্যাব দড়িটা ছুড়ে ফেলে মেয়েটার পিছনে ছুটলেন।
ছুটতে-ছুটতে তিনি বিড়বিড় করতে থাকেন, ‘আকাট গবা জার্মান ছেলেটা...আকাট গবা কোথাকার!’

(সংক্ষেপিত)




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.