|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
গ্রাম থেকে রাস্তায়, তার পর চাকার নীচে
গাছের একটা বাড়তি পাতাও ঝরে পড়েনি |
একটা, দুটো, তিনটে গল্প। আসলে অসংখ্য গল্প। হারিয়ে যাওয়ার, চলে যাওয়ার, মরে যাওয়ার। অর্ধ শতাব্দী ধরে
এই সব গল্পের সাক্ষী হতে হতে আজ মনে হয়, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের একটা অঙ্গীকার ছিল,
যত দিন দেহে প্রাণ থাকবে, জঞ্জাল সরিয়ে নবাগত শিশুদের বাসযোগ্য করে এই পৃথিবীকে আমরা রেখে যাব।
আমরা তা পারিনি। করিনি। করছি না।’ লিখছেন
তুষার কাঞ্জিলাল |
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে শান্তিতে থাকব বলে একটি দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলাম। দ্বীপটি ছিল বহির্জগৎ থেকে প্রায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তার সম্পদ ছিল চার দিকে ঘেরা লোনা জলের নদী এবং জঙ্গল। পাঁচটি গ্রাম নিয়ে সেই দ্বীপ। জনসংখ্যা হাজার ছয়েক। বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসত। গোটা দ্বীপে একটিও পাকা দালান ছিল না। গেঁও, গরান, হেঁতাল এবং এই জাতীয় বনজ ছোট গাছের খুঁটি ও বাঁশের কাঠামোর ওপর মাটি লেপে দেওয়া ঘরের দেওয়াল এবং মাথার উপরে খড়ের চাল। এখনকার হাই ইল্ডিং ভ্যারাইটির ধানগাছের খড় বেঁটে, ওতে খড়ের চাল হয় না। তাই পাকা দালান, অ্যাসবেসটসের ছাউনি আর মরা গরিবদের কুঁজি, এগুলি দ্বীপবাসীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। যাক, যে কথা বলছিলাম, তখন দ্বীপের মধ্যে হাঁটুরে ছাড়া রাস্তাঘাট ছিল না, এ-পাড়া ও-পাড়া করতে গেলে নদীবাঁধ বা জমির আলই একমাত্র ভরসা। পরিধেয়ও ছিল খুব সংক্ষিপ্ত। নগ্নপদ গাঁধীজির মাপে এক খণ্ড বস্ত্র আর উদোম গা বা কাঁধে একটা গামছা। একখানা ধুতি আর গেঞ্জি সোডা-কাচা হয়ে তোরঙ্গে তোলা থাকত। কোনও কারণে বিশেষ সাজগোজের প্রয়োজন হলে সে-দুটো তোরঙ্গ থেকে বেরোত।
আয়ের উৎস ছিল শুধু একফসলি জমিতে, ঝড় বন্যা বা খরা না হলে, একরে আঠারো মণের মতো ধান। লোনা জলের মাছ অনেক পাওয়া যেত, বর্ষা বেশি হলে মাঠে-ঘাটে ও মাঠ-পুকুরে ট্যাংরা বা অন্যান্য কালো জাতের মাছের জোগান ছিল প্রচুর। ক্রোশ-দুই দূরে একটা বড় হাট অবশ্য ছিল, প্রতি শনিবার সেটা বসত। |
|
কোথায় দায়বদ্ধতা। সুন্দরবন, আজও যেমন। |
এই হাটে যাওয়াটা মানুষের কাছে ছিল অতি আবশ্যিক। বেচাকেনার জন্যে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি পাশের দশ-বিশ গ্রামের আত্মীয়স্বজন জ্ঞাতি-কুটুম্বদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ এবং সংবাদের আদানপ্রদান। হাট থেকে সাধারণত কেনা হত ধুতি, শাড়ি, সরষের তেল, পান, দোক্তাপাতা ইত্যাদি ইত্যাদি। গাঁয়ের একটু অবস্থাপন্ন যারা, তাদের সময় কাটাবার পথ ছিল চার হাতের মেলা বসানো। হরতন, রুহিতন, ইস্কাবন ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে ‘ফিস্টি’ জাতীয় জিনিস হত। পাঁঠা কেটে ভাগান করে বেচা হত, বাঁধা খদ্দের। মুরগির প্রকোপ রান্নাঘরে বড় একটা ছিল না।
চার দিকে সবটাই ছিল খোলামেলা, প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি। মানুষের চলনবলন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি, সব কিছুতেই প্রকৃতির প্রভাব স্পষ্ট দেখা যেত। একফসলি দেশ, তাও নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রায়ই মার খেত। উত্তর ভারতে বহু জায়গায় ঘুরেছি। সেখানে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, কেমন আছেন? গরিবগুর্বোরাও উত্তর দেবে, ‘বড়িয়া হ্যায়, মজেমে হ্যায়’। সে কালে সুন্দরবনের গ্রামেও এ ধরনের উত্তর পাওয়া যেত। হাজার অপ্রাপ্তির দুঃখবোধ খুব একটা দেখিনি। দু’এক বেলা না খেয়ে থাকাটা প্রায় অভ্যেসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তিনটি গ্রামে সে সময় সমীক্ষা করে দেখেছিলাম, প্রায় ৪১ শতাংশ মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো ভাত পান না। গাঁয়ে-গঞ্জে ছেলেপিলেরা বাগাল খাটত আর ভূমিহীনরা অবস্থাপন্নদের বাড়িতে সংবৎসর মুনিশ-মাহিন্দর হিসেবে খাটত। তিনটি ঘটনা এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
|
‘খেতে দেয় না, পেটায়’ |
আমার প্রয়াতা স্ত্রী বীণাদেবী নারীদের ভাগ্য ফেরাবার অভিযানে নেমেছিলেন। একদিন মেঠো পথে যাচ্ছেন, দেখলেন, এক মা ছেলেকে নির্মম ভাবে পেটাচ্ছেন। তিনি দৌড়ে কাছে গেলেন, মা’টিকে সবলে নিবৃত্ত করে মারার বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন। যেটা বুঝলেন সেটা হচ্ছে, ১০ বছরের ছেলেটি এক বাড়িতে বাগাল খাটে। একদিন পালিয়ে বাড়ি চলে এসেছে এবং ঘোষণা করেছে যে সে আর ও বাড়িতে যাবে না। বীণাদেবী ছেলেটিকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, মরা গরিবের ঘরে জন্মেছিস, তোকে তো বাগাল খেটেই বাঁচতে হবে। ছেলেটি চিৎকার করে বলল, ‘আমি তো বাগাল খাটব না বলিনি, কিন্তু ও বাড়িতে আর নয়, ওরা আমাকে খেতে দেয় না, আর তার পর যখন তখন পেটায়।’ মা কিন্তু ও বাড়িতেই পাঠাবে। ছেলে শরাহত বন্য প্রাণীর মতো আর্তনাদ করে বলল, ‘পাঠাবে না? না পাঠিয়ে উপায় আছে? আমাকে রেখে আগাম চার বস্তা ধান মালিকের থেকে নিয়ে খেয়ে বসে আছে!’ বীণাদেবীও সন্তানের মা ছিলেন। তিনি মাতৃস্নেহের এই ভয়াবহ রূপ দেখে মাঠের আলে বসে হু-হু করে কাঁদতে শুরু করলেন।
|
‘খেয়ে আসিনি’ |
দ্বিতীয় ঘটনাটি আমার নিজের অভিজ্ঞতা। স্কুলে নিজের ঘরে বসে আছি। একটি শীর্ণ, দুর্বল, চোখে-মুখে বুদ্ধির ধার, পড়াশোনায় খুবই ভাল বছর দশেকের ছেলে এসে আমার ঘরে ঢুকল। তখন সবে তৃতীয় ঘণ্টা। বলল, ‘স্যর, বাড়ি যাব।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কেন যাবি?’ উত্তর পেলাম, ‘খেয়ে আসিনি।’ ‘কেন খেয়ে আসিসনি?’ ‘বাড়িতে কাল থেকে খাবার কিছু নেই।’ ‘এখন বাড়ি গিয়ে কী করবি? এখনও তো খাবার পাবি না।’ সে বলল, ‘বাড়িতে একখানা কাঁসার থালা বাকি ছিল, সেটা বেচতে বাবা হাটখোলায় গেছেন। যদি বেচতে পারেন, তা হলে মাইলো নিয়ে বাড়ি আসবেন।’ কিছু খাবার আনিয়ে ছেলেটিকে খেতে দিয়ে বললাম, ‘বোস।’ তার পর সেই ক্লাসে একটা নোটিস পাঠিয়ে জানতে চাইলাম কত জন ছাত্র না খেয়ে স্কুলে এসেছে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ৬৭টি ক্ষুধার্ত মানবসন্তান আমার কাছে হাজির হল। সেই মুহূর্তে নিজেকে চরম অসহায় এক জন অত্যাচারী মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যে সমাজ এ ধরনের ক্ষুধার্ত শিশুদের মুখে অন্ন জোগাবার দায় নিতে পারে না, সে সমাজ যত তাড়াতাড়ি ধ্বংস হয় ততই মঙ্গল। আমার এবং আমার স্ত্রীর অন্যান্য সহকর্মীদের যার কাছে যা ছিল সব দিয়ে হাটখোলায় খাবার আনতে পাঠালাম। খেতে পাবে, এই আশায় মানবসন্তানগুলির মুখে-চোখে যে-পরিবর্তন লক্ষ করেছিলাম, তা আজও ভুলিনি। সেটা ভোলার মতো ঘটনা নয়।
|
‘জঙ্গলেই আমাদের মরণ’ |
তৃতীয় অভিজ্ঞতাও সমান বেদনার। শিবু জঙ্গলে মহাল করতে যায়। গুনিন বলে কিছু নামডাকও আছে। এক বার শিবু ভাইকে নিয়ে মহালে মধু ভাঙতে গেল। কিন্তু ভাইকে নিয়ে ফিরে আসতে পারল না। তার চোখের সামনে ভাইকে বাঘ ঘাড় কামড়ে জঙ্গলে টেনে নিয়ে গেল। শিবু দোহারা চেহারার লাবণ্যময় পুরুষ। জীবনযাত্রার রুক্ষ পথে হেঁটে-হেঁটে এবং বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোয় চেহারায় একটা বুনো ভাব ছিল। ভাইকে হারানোর পর আমার কাছে এল। দেখে মনে হল একটা ভাঙা মানুষকে দেখছি। বললাম, ‘তোমাকে আর জঙ্গলে যেতে হবে না। তুমি আমাদের যে লঞ্চ আছে, এরপর সেখানে কাজ করবে।’ কিছু দিন পর সে বলল, সে কাজ তার ভাল লাগছে না। সে আমাদের সংগঠনের গ্রাম-কর্মী হয়ে গেল। গ্রামের মানুষকে সংগঠিত করে তাদের আয়-উপার্জন বাড়াবার চেষ্টা করল। আরও কিছু দিন বাদে হঠাৎ দুপুরবেলা খবর পেলাম ওকে বাঘে খেয়েছে। দৌড়ে তার গ্রামে গেলাম। বিকেলের ঝোঁকে দু’খেপ ফেলে কিছু মাছ ধরার চেষ্টায় জঙ্গলে ঢুকেছিল, আর ফেরেনি। মাঝে মাঝেই আমাকে বলত, ‘মাস্টারবাবু, জঙ্গলেই আমাদের মরণ; এটাই আমাদের কপালে লেখা আছে। আপনি আমাকে জঙ্গলছাড়া করতে চেয়েছেন। আমি যে জাত-বুনো। সূর্য ডোবার সময় নদীর ওপার আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সে ডাকের একটা মোহিনী মায়া আছে। তার ফাঁদে না পড়া পর্যন্ত বিকার আমাকে ছাড়ে না। তাই আমি বার বার প্রাণটুকু হাতের মুঠোয় নিয়ে ঢুকি। সেই শিবুর ললাটলিখন মোছা যায়নি। |
|
আজকে যখন সেই গ্রামে যাই, দেখি, প্রায় সব কিছু পালটে গেছে। মানুষে মানুষে ছয়লাপ। উন্নয়নের জোয়ারে নাগরিক গুণগুলি নয়, দোষগুলি গ্রামের মানুষকে সব ভুলিয়ে দিচ্ছে। এই কলকাতা শহরেই হাজারে হাজারে সেই মানুষগুলিকে বস্তিতে বাস করতে দেখি। তাদের মরণ জঙ্গলে হয় না। মরার শহুরে কেতায় এখন তারা মরে। শুধু মরার আগে খোলামেলা আকাশ-বাতাস-জঙ্গল-নদী ওদের সঙ্গে থাকে না।
গত পাঁচ দশকে এই জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থা, চাহিদার রূপান্তর, সংস্কৃতির জগতের পরিবর্তন, মানসিকতার অকল্পনীয় পরিবর্তন দেখলাম। গ্রামে গ্রামে শ্রেণিবিভাজনের প্রত্যক্ষ ছবি। গোনাগুনতি কিছু মানুষের রমরমা আর বাকিদের মরা গরিবের হাল। সংখ্যাবৃদ্ধিও আনুপাতিক হারে। একটু অবস্থাপন্ন এবং জোয়ানমদ্দরা গ্রামছাড়া হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি তাদের জীবন থেকে এবং মন থেকে বিদায় নিয়েছে। জানি না, আরও এ ধরনের দৃশ্য দেখার জন্য কত দিন বেঁচে থাকতে হবে।
|
‘মাসি, ক্ষুধা লাগছে’ |
এক দিন দমদম স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি আমার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী সর্দারপাড়ার বলাই সর্দারের ছেলে হেঁকো দাঁড়িয়ে আছে। বয়স ১২/১৩ মতো হবে। আধপোড়া একটি বিড়িতে সুখটান দিতে গিয়ে আমার দিকে চোখ পড়ায় সেটা ফেলে সামনে এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে জনা পাঁচ-ছয় ওই বয়সেরই ছুপা মস্তান। জিজ্ঞেস করলাম ‘কী রে, তুই এখানে? কোথায় থাকিস?’ ঝটিতি উত্তর, ‘দমদম স্টেশনের এই প্ল্যাটফর্মে।’ আমি কত বড় মানুষ, সেটা সঙ্গের বালকবৃন্দকে বোঝাবার চেষ্টা করল। হেঁকোর সঙ্গে প্রথম আলাপ বাদায়; আমার বসার ঘর, শোবার ঘর কাম ডাইনিং হলের খড়ের চালের ঘরের সামনে। একদিন ভোরবেলায় কাক-চিৎকার: ‘মাসি, ক্ষুধা লাগছে, খাইত দাও।’ যাঁর উদ্দেশে এই বার্তা, তিনি তখনও বিছানা ছাড়েননি। হেঁকোর চিৎকারে ঘুম ভাঙল। তিনি অত্যন্ত ধীর গতিতে বিছানা ছাড়লেন এবং ঘরের মুড়ির টিন থেকে এক বাটি মুড়ি হেঁকোর গামছার খুঁটে বেঁধে দিলেন। হেঁকো পরমানন্দে নাচতে নাচতে আমার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। হেঁকোর বাবা বাঁধের ঢালের চরের বাসিন্দা বলাই সর্দার। দিনমজুরি করে এক গণ্ডার পেটের ভাত জোগাড় করতে কাজের খোঁজে বেরোয়। কোনও দিন পায়, কোনও দিন পায় না। যে দিন পায় না, সে দিন সকাল থেকেই কুৎসিত ভাষায় কোলাহলের শব্দ শোনা যায়। তবে একটি ব্যাপারে বলাইয়ের গ্রাম জুড়ে খ্যাতি। সেটা হচ্ছে তার খাওয়ার পরিমাণ। আমার বাড়িতে একদিন তাকে খেতে বলা হয়েছিল। সে সতেরো বার ভাত চেয়ে খেল। ঘরনীর মাথায় হাত! এর পরেও ভাত চাইলে শূন্য হাঁড়ি। বলাই নিত্য-রোজ খাবার বায়না ধরত না। কিন্তু হেঁকোর বাঁধা রুটিন। রোজ সকালে ‘মাসি, ক্ষুধা লাগছে।’ আমি তাকে ঘুম ভাঙিয়ে বলতাম, তোমার ভগ্নীপুত্র এসেছে। যা হোক একটা ব্যবস্থা করো।
মাঝে শুনলাম, বলাই ও-পাড়া ছেড়ে এবং ঘরসংসার চুলোয় দিয়ে আরও দক্ষিণে নতুন সংসার পেতেছে। হেঁকো তার হাড়সর্বস্ব জননী, একটি ভাই, একটি বোন নিয়ে পথের ভিখিরি। ভিখারিকে নিত্য পোষা যায় না। প্রথম দিকে গ্রামের লোক কিছুটা সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এল। একটা সময় পর থেকে সেটা বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক দিন বাদে শুনলাম, হেঁকোর মা বালবাচ্চা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। অনেক দিন খবর পাই না। তার পর দমদম স্টেশনে হেঁকোর সঙ্গে এই সাক্ষাৎকার। কৌতূহল নিয়ে হাজারো প্রশ্ন তাকে একসঙ্গে করতে লাগলাম। ‘কোথায় আছিস, মা-ভাই-বোনরা কোথায় আছে?’ হেঁকোর পরনে একটি আধময়লা ছেঁড়া প্যান্ট আর উদোম গা। নানা প্রশ্নের উত্তরে সারবস্তু যা বোঝা গেল, মা বছরখানেক আগে সাত বাড়িতে ঝিগিরির পরিশ্রম এবং প্রায় অভুক্ত থাকার কারণে মারা গেছেন। হেঁকো এবং তার ভাই-বোনেরা তিনটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের বাসিন্দা। ভিক্ষে বা চুরি করে যে যার পেটের ভাত জোটায়। যে দিন কারওরই কিছু জোটে না, তিন ভাইবোন রেল লাইনের পাতের উপর নিশ্চুপ বসে থাকে। রাক্ষসের খিদে পেটে নিয়ে কিছু ভাবাও যায় না, কিছু বলাও যায় না। বোনটি একটু ডাগর হয়ে উঠেছে। কৌমার্য এর মধ্যেই বলি দিতে হয়েছে। ওরই আয়পায় একটু বেশি। কিছু বাঁচলে দাদা-ভাইদের জন্য এটা-ওটা কিনে নিয়ে আসে।
সে দিন স্টেশন থেকে বিদায় নেওয়ার পর অনেক দিন আর খবর জানি না। মাস তিনেক পরে আর এক বার দমদম স্টেশনে যেতে হয়েছিল। হেঁকোর মতোই যে ছেলেছোকরারা স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়, তাদের ডেকে হেঁকোর সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করলাম। একটি ছেলে আমার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, ‘হেঁকো? সে তো মরে ভূত হয়ে গেছে।’ কী হয়েছিল জিজ্ঞেস করাতে বলল, চলন্ত গাড়িতে উঠতে গিয়ে গাড়ির হ্যান্ডেল ধরতে না পেরে এক জন যাত্রীর হাত ধরে ঝুলে পড়েছিল। যাত্রীটি তাল সামলাতে না পেরে হেঁকোর হাত ছাড়িয়ে দেয় এবং তার পর ট্রেনের তলায় চাকার নীচে। হেঁকোর অমৃতলোকের পথে যাত্রার এটাই হচ্ছে ইতিহাস।
মুহূর্তের মধ্যে সব স্মৃতি একসঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠল। কেন জানি না, অনাত্মীয় রাস্তার মানুষের হঠাৎ মৃত্যুসংবাদ আমাকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিল। মনে যেন কিছুই মেনে নিতে পারছি না। হেঁকোর মতো ছেলেরাও মানুষ, মানুষেরই সন্তান। তাদের জন্য এত বড় পৃথিবীতে ঠাঁই হল না। পেটে দু’মুঠো ভাত জুটল না। কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলল না। দু’দণ্ড শিয়রে বসে কাঁদল না। হেঁকো চলে গেল, হেঁকো চিরতরে চলে গেল। হেঁকোরা এমনি করেই যায়। চরম স্বার্থপর পৃথিবী একই ভাবে চলছে। একটা গাছের পাতাও বাড়তি ঝরে পড়েনি। এক বিন্দু বৃষ্টিও তাকে স্মরণ করে মাটি ভেজায়নি। বয়স হয়েছে, মহাশূন্যের দিকে তাকিয়ে আকাশের তারামণ্ডলীতে তাদের খোঁজ করার চেষ্টা করি।
চার দিকে যখন তাকাই, দেখি, এক দিকে দারিদ্র, দুঃখ, শোষণযন্ত্রণা সমাজের বৃহদংশকে শিকার করে ফেলেছে, অপর দিকে লোভ, যার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই, কতিপয়ের প্রাচুর্য, খোলামকুচির মতো টাকার খেলা, ভোগের তুঙ্গে বসে সমাজকে শাসন করে যাচ্ছে। এর মধ্যে কোথায় মনুষ্যত্ব, কোথায় বিবেক, কোথায় সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা।
এ বয়সে মনে হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের একটা অঙ্গীকার ছিল। সেটা হচ্ছে, যত দিন দেহে প্রাণ থাকবে, এই পৃথিবীর জঞ্জাল সরিয়ে নবাগত অমৃতের শিশুদের বাসযোগ্য করে এই পৃথিবীকে আমরা রেখে যাব। আমরা তা পারিনি। করিনি। করছি না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এর দাম মেটাবার দায় দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কিছু হয় না। |
|
|
|
|
|