বড় হওয়ার বাসনা থাকিলে আগে ছোট হওয়া বিধেয় অন্তত এক কবি তেমনই লিখিয়াছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের শাসককুল, রাজনৈতিক রঙ নির্বিশেষে, কিঞ্চিৎ সংস্কৃতিমনস্ক। কবির কথায় তাঁহারা গুরুত্ব দিয়া থাকেন। এই ক্ষেত্রেও বোধ হয় দিয়াছেন। তাঁহাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে হয়তো বৃহৎ শিল্পের বাসনা আছে, তাই তাঁহারা শিল্পের প্রসঙ্গ উঠিলেই ক্ষুদ্র শিল্পের কথা বলেন। কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নহেন তিনি ছাদে বড়ি দেওয়া হইতে রবীন্দ্রনৃত্য, সব কিছুকেই শিল্পের আওতায় আনিয়া বিপ্লব ঘটাইয়া ফেলিয়াছেন তাঁহার পূর্বসূরিরাও শিল্প বলিতে ক্ষুদ্র শিল্পই বুঝিতেন। অসীম দাশগুপ্তের ‘বিকল্প বাজেট’ নামক হাস্যকৌতুকটি পশ্চিমবঙ্গের স্মৃতিপট হইতে এখনও মুছিয়া যায় নাই। অসীমবাবু ভাবিতেন, ক্ষুদ্র শিল্পের হাত ধরিয়াই পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের বানভাসি হইবে। অসীম দাশগুপ্ত অতীত, কিন্তু তাঁহার ‘বিকল্প অর্থনীতি’র ভাবধারা এই রাজ্যে বহাল তবিয়ত। তৃণমূল কংগ্রেসের নীতিকাররা তাহার উত্তরসাধক। তাঁহারা চাহিতেছেন, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের উপর জোর দিতে হইবে। কেন? উত্তর: অগত্যা। দলনেত্রী গোঁ ধরিয়াছেন, শিল্পকে তিনি সূচ্যগ্র জমিও ছাড়িবেন না। এই দিকে, অন্তত মুখে ‘শিল্প চাই’ না বলিলে লোকে মন্দ বলিবে। জমিও দেওয়া হইল না, শিল্পও থাকিল, ক্ষুদ্র শিল্প ছাড়া এমন সমাধান আর কোথায়? অতএব শিল্প মন্ত্রকের ‘উপদেষ্টা’ সৌগত রায় মহাশয় যদি মুখ্যমন্ত্রী সমীপেষু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসারের জন্য সুপারিশ করেন, বিস্ময়ের কিছু নাই। দলনেত্রী নিশ্চয়ই তাহাতে খুশি হইবেন। যাঁহাদের কাণ্ডজ্ঞান আছে, পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ে উদ্বেগও আছে, তাঁহারা অবশ্য আতঙ্কিত হইবেন। অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন যেমন। রাজ্য সরকারের জমি-নীতি তিনি বুঝিতে পারেন নাই। স্বাভাবিক। সরকার যদি জমির বাজার হইতে হাত তুলিয়া লয়, তাহাতে যে জমির মালিকদেরও ক্ষতি, শিল্পপতিদেরও অসুবিধা, এবং সব মিলাইয়া রাজ্যের উন্নয়নসম্ভাবনার মূলে কুঠারাঘাত, এই কথাটি যে কোনও যুক্তিশীল মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বলিয়া মনে হইবে। পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা সেই কাণ্ডজ্ঞান কোথায় বিসর্জন দিলেন, এই প্রশ্ন বিচিত্র নহে। প্রণববাবু বলিয়াছেন, রাজ্য সরকার যে জমি-নীতি গ্রহণ করিয়াছে, তাহাতে কিছু বিশেষ গোত্রের শিল্প হইতে পারে অর্থাৎ, ওই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কিন্তু বড় মাপের শিল্পায়ন অসম্ভব। আর এক অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক বলিয়াছেন, বড় শিল্প না হইলে উন্নয়ন হইবে না, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ক্রমে আরও দরিদ্র হইবেন এবং আরও প্রাণপণে জমিকে আঁকড়াইয়া থাকিতে চাহিবেন। তাহাতে উন্নয়ন আরও ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল শাসকরা রাজ্যবাসীকে তীব্র এবং দীর্ঘমেয়াদি অনুন্নয়নের অন্ধকূপে ঠেলিয়া দিতেছেন। সেই অন্ধকূপে ক্ষুদ্র শিল্প বড়জোর রেড়ির তেলের প্রদীপ হইবে অন্ধকারের ইতরবিশেষ হইবে না। ক্ষুদ্র শিল্প অতি জরুরি বিষয়, রাজনীতিকদের চোখে সুন্দরও। কিন্তু তাহাই যদি একমাত্র হয়, তবে ঘোর বিপদ। শাসক পাল্টাইয়াছে, বিপদটি যথাপূর্বম্। |