ঝাড়খণ্ডে রাজ্য সরকারের পতন হইয়াছে। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুণ্ডা সরকার হইতে সমর্থন প্রত্যাহার করিয়া লওয়াতেই এই আকস্মিক সঙ্কট। ৮২ আসনের বিধানসভায় বিজেপি ও জেএমএমের সমসংখ্যক (১৮ জন করিয়া) বিধায়ক। মোর্চা নেতা ‘গুরুজি’ শিবু সোরেন সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকায় বিজেপির পক্ষে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিধায়ক সংগ্রহ করা তাই দুঃসাধ্য হইয়া পড়ে। আড়াই বছর আগে জোট সরকার গড়ার সময় বিজেপি নাকি মোর্চা নেতৃত্বকে আশ্বাস দিয়াছিল, ক্ষমতায় থাকার পাঁচ বছর আধাআধি করিয়া দুই দল সরকার চালাইবে। তদনুযায়ী এই মাসেই অর্জুন মুণ্ডার মুখ্যমন্ত্রিত্ব মোর্চা নেতা হেমন্ত সোরেনকে সঁপিয়া দেওয়ার কথা। কিন্তু মুণ্ডা কিংবা বিজেপি নেতৃত্ব এমন কোনও শর্ত বা চুক্তির কথা অস্বীকার করিয়াছেন। মোর্চাকে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনও পরিকল্পনাও তাঁহাদের নাই। অতএব সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়ে।
প্রাদেশিক স্তরে জোট সরকারের মেয়াদ এই ভাবে দুই প্রধান জোট-শরিকের মধ্যে আধাআধি ভাগ করিয়া লওয়ার বোঝাপড়াটি অতীতেও কার্যকর হয় নাই। উত্তরপ্রদেশে কাঁসি রাম ও মুলায়ম সিংহ যাদবের মধ্যে শাসনক্ষমতা ভাগ করিয়া লওয়ার কিংবা পরবর্তী কালে বহুজনসমাজ পার্টি ও বিজেপির মধ্যে লখনউয়ের মসনদ বণ্টন করিয়া লওয়ার বোঝাপড়াটি ভাঙিয়া গিয়াছিল। কারণ নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে চুক্তির শর্ত পূরণের পরিবর্তে কথার খেলাপ করাই দস্তুর হইয়া ওঠে। ঝাড়খণ্ডেও জোট সরকারের শরিকদের এমন বোঝাপড়া ব্যর্থ হওয়াই প্রত্যাশিত ছিল। এ ধরনের বন্দোবস্তে যে নীতি বা কর্মসূচির পরিবর্তে ক্ষমতা করায়ত্ত করার সংকীর্ণ স্বার্থই সতত ক্রিয়াশীল, তাহার মধ্যেই ব্যর্থতার বীজটিও নিহিত। শিবু সোরেন বা তাঁহার পুত্র হেমন্ত সোরেন, কেহই জনজাতীয় রাজ্যটির ভূমিপুত্রদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে এমন করিতেছেন না। বিজেপি নেতৃত্বও যে রাজ্যবাসীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতেই মোর্চার দাবির প্রতি অনমনীয়তা দেখাইতেছেন, এমনও নয়। ইহা বুঝা যায় ইস্তফাপত্রের সহিত জুড়িয়া দেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশ হইতে। সেখানে অর্জুন মুণ্ডা নির্বাচিত বিধানসভা ভাঙিয়া দিয়া পুনর্নির্বাচনের পরামর্শ দিয়াছেন। তাঁহার যুক্তি: বিধানসভা জিয়াইয়া রাখিলে সেখানে ‘ঘোড়া কেনাবেচা’র অর্থাৎ রজতমুদ্রার বিনিময়ে দলীয় ও নির্দল বিধায়কদের আনুগত্য ক্রয় করিয়া সরকার গড়ার অপপ্রয়াস চলিতে থাকিবে। তাহাতে আয়ারাম-গয়ারামদেরই সুদিন। তেমন সম্ভাবনা বা আশঙ্কা যে একেবারে নাই, এমন নয়। কিন্তু সেই অজুহাতে পাঁচ বৎসরের পূর্ণ মেয়াদ সক্রিয় না রাখিয়া আইনসভাকে মধ্যপথে এ ভাবে রদ করিয়া দেওয়া কি উচিত? জনসাধারণ কি কিছু দিন ছাড়া-ছাড়াই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে লাইন দিবেন? নিজেদের ব্যর্থতার জন্য এ ভাবে রাজ্যবাসীকে তাহার মাসুল গনিতে বাধ্য করা অন্যায়। এই মুহূর্তে বিকল্প স্থায়ী সরকার গঠনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। পরিস্থিতি বিবেচনা করিয়া ঝাড়খণ্ডে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করাই হয়তো একমাত্র পথ। নির্বাচিত বিধানসভা রাজ্যে জিয়াইয়া রাখা হউক, তাহাতে অদূর ভবিষ্যতে সেই আইনসভা হইতে বিকল্প সরকার গড়িয়া ওঠার সম্ভাবনাও জিয়াইয়া থাকিবে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একটি হতদরিদ্র রাজ্যের মানুষদের উপর নির্বাচনের মতো ব্যয়বহুল সাংবিধানিক কাণ্ডের বোঝা উপর্যুপরি চাপাইয়া দেওয়া উচিত নয়। নির্বাচন অনুষ্ঠানের অর্থ বেশ কিছু কাল যাবৎ উন্নয়নের কর্মসূচি রূপায়ণও স্থগিত থাকা। ঝাড়খণ্ডের মতো অনগ্রসর রাজ্যের পক্ষে সেটাও একটা অভিশাপের মতো। সর্বোপরি, নির্বাচিত আইনসভার পাঁচ বছরের মেয়াদটি কোনও ক্রমেই সঙ্কুচিত করা উচিত নয়। বিজেপির পক্ষে বন্দোবস্তটি তত স্বস্তিকর না হইতে পারে। দলীয় নেতৃত্বের কাছে একটি রাজ্যে ক্ষমতা হারাইবার তুলনায় বিধানসভা ভাঙিয়া দিয়া পুনর্নির্বাচন মারফত দ্রুত সেই ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে অধিকতর আকর্ষণীয় হইতে পারে। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপালের বিজেপি নেতৃত্বকে তুষ্ট করিয়া চলার কোনও দায় নাই। তাঁহার উচিত নির্বাচিত আইনসভা হইতেই বিকল্প সরকার গঠনের সম্ভাবনাগুলি খতাইয়া দেখা। |