নির্যাতিতা কিশোরীর মা থানায় গিয়ে অভিযোগ করেছিলেন ধর্ষণের। অথচ কড়েয়া থানা শ্লীলতাহানির মামলা রুজু করেছিল শাহাজাদা বক্সের বিরুদ্ধে। নিজেদের ‘সোর্স’ শাহাজাদাকে বাঁচাতেই কড়েয়া থানার পুলিশ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হাল্কা করে দেখিয়েছিল বলে যুগ্ম কমিশনার (সংগঠন) আর ত্রিপুরারি পুলিশ কমিশনারকে রিপোর্টে জানিয়েছেন।
ওই কিশোরীকে শাহজাদার অত্যাচার থেকে বাঁচাতেই তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় যুবক আমিনুল ইসলাম, যাঁর অপমৃত্যুর ঘটনা ঘিরে এখন শোরগোল পড়েছে। শাহজাদাকে আড়াল করতে পুলিশের তৎপরতা, ধর্ষণ-মামলা প্রত্যাহারে চাপ, এবং এ সবের জেরে তাঁকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো ও পুলিশি হেনস্থার অভিযোগ তুলে গত ৩ ডিসেম্বর কড়েয়া থানার সামনে নিজের গায়ে আগুন দেন আমিনুল। পয়লা জানুয়ারি তিনি মারা যান। রিপোর্টে ত্রিপুরারি বলেছেন, আমিনুলের বিরুদ্ধে গত ৩১ অক্টোবর হামলা ও চুরির মামলা রুজু হলেও ২২ নভেম্বর তাতে ডাকাতির মতো গুরুতর অভিযোগ কী ভাবে ও কার মদতে ঢুকল, তার বিস্তারিত তদন্ত প্রয়োজন।
পাশাপাশি ঠিক কী কারণে শাহজাদা ও পুলিশের মধ্যে এমন গভীর আঁতাত গড়ে উঠেছিল, তা আরও ভাল ভাবে খতিয়ে দেখার সুপারিশ করেছেন যুগ্ম কমিশনার। ‘ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগকে হাল্কা করে দেখিয়ে কড়েয়া থানার পুলিশ শুধু আইনই ভাঙেনি, মেয়েটির মানবাধিকারও হরণ করেছে।’ রিপোর্টে মন্তব্য করেছেন তিনি। আর এরই প্রেক্ষিতে কড়েয়া থানার সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার ও কর্মীদের বিরুদ্ধে এনেছেন কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ।
আমিনুল-শাহজাদা কাণ্ডে কড়েয়া থানার পুলিশের ভূমিকা ঠিক কী ছিল, তা যাচাই করতে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দার নির্দেশে ত্রিপুরারি শুক্রবার তদন্তে নেমেছিলেন। শনিবার দুপুরে তিনি আমিনুলের বাড়িতেও যান। সোমবার দুপুরে সিপি’কে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন ত্রিপুরারি। তাতে তিনি বলেছেন, অত্যাচারিতা কিশোরী গত ২২ নভেম্বর বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দি দেওয়ার পরেই কড়েয়ার পুলিশ শাহজাদার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা রুজু করে। আর তার পরেই অমিনুলকে ডাকাতির অভিযোগে জড়ান শাহজাদার স্ত্রী নিলোফার। সেই মতো কড়েয়া থানাও ভারতীয় দণ্ডবিধির গুরুতর ধারায় আমিনুলের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে।
এবং সেই ‘ডাকাতি’র তদন্ত করতে গিয়ে কড়েয়া থানার তদন্তকারী অফিসারেরা যখন বার বার আমিনুলের বাড়িতে হানা দিয়েছেন, ধর্ষণে অভিযুক্ত শাহজাদা তাঁদেরই কাছ থেকে তখনও ‘জামাই আদর’ পেয়ে এসেছে কেন, তদন্ত-রিপোর্টে সে প্রশ্ন তুলেছেন ত্রিপুরারি। এমনকী তাঁর দাবি, আমিনুলের বিরুদ্ধে তদন্ত কোন পথে, কী ভাবে এগোবে, তার পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে শাহাজাদার উপস্থিতিতে। শুধু তা-ই নয়, আমিনুলের বিরুদ্ধে কী ধরনের পাল্টা অভিযোগ দায়ের করতে হবে, পুলিশের কাছ থেকেই শাহাজাদা ও তার পরিবার সে ব্যাপারে পরামর্শ পেয়েছে বলে রিপোর্টে ইঙ্গিত দিয়েছেন যুগ্ম কমিশনার। একই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, কলকাতা পুলিশের সংশ্লিষ্ট দক্ষিণ-পূর্ব ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) গোটা বিষয়টি নিয়ে লালবাজারকে অন্ধকারে রাখলেন কীসের স্বার্থে? যেখানে পুলিশ ডিভিশনের মুখপাত্র হিসেবে লালবাজারের সঙ্গে সমন্বয়রক্ষার দায়িত্ব ডিসি-রই?
তবে যুগ্ম কমিশনারের রিপোর্টে অভিযুক্ত হিসেবে কোনও পুলিশকর্মীর নাম নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়নি। লালবাজার-সূত্রের খবর: প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে সাসপেন্ড করা হয়েছে কড়েয়া থানার তিন পুলিশকর্মীকে। এঁরা হলেন দুই সাব ইন্সপেক্টর বিনোদ কুমার ও রঞ্জিত যাদব এবং কনস্টেবল নাসিম খান। তাঁদের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ফৌজদারি মামলা রুজু হয়েছে। লালবাজারের ওই অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে প্রকাশ, অভিযুক্ত পুলিশদের এক জন প্রায় পাঁচ বছর নাগাড়ে কড়েয়া থানায় কর্মরত ছিলেন, যা সম্পূর্ণ ভাবে পুলিশি নিয়ম-বহির্ভূত। কীসের সুবাদে তিনি তিন বছরের নির্দিষ্ট মেয়াদ উতরেও একই থানায় এত দিন বাড়তি কাটালেন, সে সম্পর্কেও তদন্ত চেয়েছেন ত্রিপুরারি।
এ দিকে বুধবার আলিপুরে জেলা ও দায়রা জজের আদালতে শাহাজাদার তরফে মামলাটি বিচারে স্থগিতাদেশ চাওয়া হলে আদালত তা খারিজ করে দিয়েছে। ভারপ্রাপ্ত বিচারক সুদেব মিত্র মামলাটির বিচারের দায়িত্বভার এ দিন পঞ্চদশ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সুনির্মল দত্তের আদালতকে সঁপেছেন। অভিযুক্ত শাহজাদাকে আগামী ২২ জানুয়ারি সেখানে হাজির করাতে হবে। গত ১৮ ডিসেম্বর শাহজাদার জামিনের আবেদন এক বার অগ্রাহ্য হয়েছে। আপাতত সে জেল হাজতে। |