জীবনভর সংগ্রাম, কয়েক দফা হতাশার পরে, অবশেষে ‘স্বভূমি’তে পা দিয়েছেন ওঁরা। চতুর্থ দফায় ইজরায়েলে পৌঁছেছেন ৫৩ জন মিজো ও মণিপুরি ইহুদি। যাঁরা বেশি পরিচিত ‘বেনে মেনাশে’ বা মেনাশের সন্তান নামে। এই নিয়ে প্রায় তিনশো বেনে মেনাশে ইজরায়েল পৌঁছলেন। তেল আভিভ পৌঁছে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে। কেউ বা চুম্বন করেন পবিত্র মাটি। তেরঙ্গার ‘পরবাস’ থেকে নীল তারার ‘স্বদেশে’ আসা শিশুরা হাতে ইজরায়েলের পতাকা উড়িয়ে রওনা হল ‘আত্তীকরণ শিবির’-এর উদ্দেশে।
জন্মভূমি মিজোরাম বা মণিপুরকে কোনও দিন মাতৃভূমি বলে মেনে নিতে পারেননি বেনে মেনাশেরা। বংশানুক্রমে, মণিপুর ও মিজোরামে থেকেও তাঁরা নিজেদের ‘ইজরায়েলের ভূমিপুত্র’ হিসাবেই বিশ্বাস করেন। মিজো, কুকি, পইতেদের বড় একটা অংশের দাবি, তাঁরা বাইবেলে উল্লেখিতহারিয়ে যাওয়া ১০টি উপজাতির একটি। কথিত আছে, খ্রিষ্টজন্মের ৭২১ বছর আগে আসিরিয়রা ইজরায়েল থেকে এই ১০টি আদি উপজাতিকে নির্বাসিত করেছিল। তাঁরা ‘জুডাইজ্ম’ পালন করতেন। তাদেরই একটি ধারা পূর্ব এশিয়া, ইউনান, মায়ানমার হয়ে মিজোরাম- মণিপুরে প্রবেশ করে। ১৯৮৯ সালে এদের প্রথম দলটি ইজরায়েল পাড়ি দেয়। ২০০২ ও ২০০৫ সালে আরও দুই দফায় ইজরায়েল পাড়ি দিয়েছিলেন মেনাশেরা। তার পর, সেখানকার সরকার মেনাশেদের ইজরায়েল আসার উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এত দিন পরে, শ’তিনেক ইহুদি, মিজোরাম ও মণিপুর ছেড়ে ইজরায়েল গেলেন। ইহুদি সংগঠন ‘স্যাভেই ইজরায়েল’ ৫৩ জন মেনাশেকে নিয়ে তেল আভিভের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে বিমান থেকে নামে। আগেভাগে সে দেশে আসা ‘বেনে মেনাশে’রা
তাঁদের স্বাগত জানাতে বিমান বন্দরে হাজির ছিলেন। ‘বেনে মেনাশে’দের ব্যাপারে প্রথম উল্লেখ করেন ‘আমিসাভ’ সংগঠনের ‘লস্ট ট্রাইব হান্টার’ রাব্বি আভিচালি। এরপর ইহুদিদের পবিত্র পুস্তক ‘তালমুদ’ মিজো ভাষায় অনুবাদ হয়। ভারতীয় ইহুদিদের দাবি, ইজরায়েলে ৭০ শতকে দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংস হওয়ার পরে পশুবলি বন্ধ হয়ে গেলেও মিজোরাম ও মণিপুরি ‘বেনে মেনাশে’রা বংশানুক্রমে পশুবলির রীতি-সহ ‘জুডাইজ্ম’ পালন করছেন।
মিজেরাম ও মণিপুর মিলিয়ে মেনাশের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার সন্তান এখনও ভারতে রয়েছেন। ১৯৮৯ সালে দুই রাজ্যের প্রায় ৮০০ জন ইজরায়েল চলে গিয়েছেন। পরের দুই দফায় গিয়েছেন আরও প্রায় ৯০০ জন। অধিকাংশের ঠাঁই হয়েছে ‘গাজা স্ট্রিপ’ এলাকায়। ২০০৩ সালের পরে মেনাশেদের অভিবাসন নিয়ে ইজরায়েলে জোর বিতর্ক শুরু হয়। বলা হয়, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যই তাদের আনা হচ্ছে। ২০০৫ সালে, ইজরায়েল সরকারের স্বীকৃতি মেলার পরে,মেনাশেদের তৃতীয় দলটি ইজরায়েল পাড়ি দিয়েছিল। এখনও ইজারায়েলে তাঁরা সার্বিক সমর্থন পাচ্ছেন না। অনেকেরই ধারণা, দারিদ্র থেকে বাঁচতেই এই পথ নিয়েছে ভারতীয় উপজাতিভুক্ত ‘বেনে মেনাশে’ গোষ্ঠী। ইজরায়েলের প্রাক্তন অভ্যন্তরীন মন্ত্রী আব্রাহাম পোরাজ সরাসরি বলেন, “ভারত থেকে আসা মানুষগুলি কোনও ভাবেই ইহুদি ঐতিহ্যের শরিক নন। প্যালেস্তাইন-আরব অধিবাসী অধ্যূষিত ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক’-এর উপরে দাবি জোরদার করতেই তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।”
তবে, স্বামী ও আট মাসের সন্তানকে নিয়ে ‘স্বদেশে’ ফেরা লিং লেনচোন্জ সেই বিতর্ক জানেন না। তাঁর কথায়, “বহু বিড়ম্বনা, অপমান সয়েছি। এতদিনে, নিজের দেশে এসেছি। আর ভাবনা নেই।” অবশ্য তাঁরা কোথায় থাকবেন, কী কাজ করবেন, সে সব কিছুই ঠিক
হয়নি। গতবারের জটিলতা এড়াতে এইবার ভারতে তাঁদের ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া হয়নি। |