কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের বাধ্যতামূলক পরীক্ষাগুলি কতটা ঠিকঠাক হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দিহান ব্লাড ব্যাঙ্কের চিকিৎসকেরাই। কারণ, রক্ত পরীক্ষার উন্নত মানের কিটের আকাল। পূর্বাঞ্চলের ‘মডেল ব্লাড ব্যাঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত মানিকতলা কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে কলকাতার পাঁচ মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্ক সর্বত্র রক্তে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, এইচআইভি ও অন্য যৌন রোগ পরীক্ষার এলাইজা কিট নেই।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, জাতীয় এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ন্যাকো) সময়ে কিট না-পাঠানোয় দু’সপ্তাহ ধরে স্থানীয় ভাবে র্যাপিড টেস্ট কিট কিনে ‘স্পট টেস্ট’ করে চালাচ্ছে ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তারা এবং হেমাটোলজিস্টরাই স্বীকার করছেন, র্যাপিড কিটের মান এলাইজা কিটের থেকে অনেক কম। ফলে পরীক্ষার ভুল ফল বেরোনোর আশঙ্কা থাকে। অর্থাৎ, রক্তগ্রহীতার দেহে মারণ রোগের জীবাণু প্রবেশের ঝুঁকি থাকে।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের রক্ত-বিশেষজ্ঞ প্রসূন ভট্টাচার্য, ‘ইমিউনো হেমাটোলজি অ্যান্ড ব্লাড ট্রান্সফিউশন’ বিভাগের প্রধান কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই বলেন, “র্যাপিড টেস্ট কিটে এলাইজা কিটের মতো ‘ইন্টার অবজার্ভার ভেরিয়েশন’ থাকে না। ফলে, রিপোর্ট ‘ফল্স নেগেটিভ’ বা ‘ফল্স পজিটিভ’ হওয়ার হার খুব বেশি। তা ছাড়া, র্যাপিড টেস্ট মানুষের নিরীক্ষণ-নির্ভর। এলাইজা টেস্ট যন্ত্রের মাধ্যমে হয়। এতে রিপোর্ট ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে।” বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (হু) বলছে, র্যাপিড কিটে ‘ফেলিওর রেট’ অত্যন্ত বেশি। তাই ন্যাকো-ও এখন এলাইজা কিটের মাধ্যমে পরীক্ষায় জোর দিচ্ছে। কিন্তু মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কের এক কর্তার কথায়, “আমাদের এলাইজার বদলে প্রায় ৩০ হাজার র্যাপিড টেস্ট কিট দেওয়া হয়েছে। তাই দিয়ে হেপাটাইটিস বি, সি, এইচআইভি সব পরীক্ষাই হচ্ছে। এলাইজার তুলনায় এই কিট অনেক নিম্ন মানের। রিপোর্ট কতটা ঠিক হচ্ছে, নিজেরাই জানি না।”
তা হলে কেন রাজ্য এড্স প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (স্যাক্স) র্যাপিড টেস্ট কিটের বদলে নিজেরা এলাইজা কিট কিনছে না? স্বাস্থ্য বিভাগের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাসের বক্তব্য, “ন্যাকো-র অনুমতি নিয়ে কিছু দিন আগেই হেপাটাইটিস সি-র ৬৮১টি কিট কেনা হয়। তা দিয়ে প্রায় ৬০ হাজার টেস্ট হয়েছে। ওই কিট শেষ। ন্যাকো বলেছে, ক’দিনের মধ্যেই হেপাটাইটিস বি, সি, এইচআইভি ও যৌন রোগ পরীক্ষার এলাইজা কিট ঢুকবে। তাই আর কিনিনি। স্পট টেস্ট দিয়ে চলছে।”
তবে স্যাক্স-কর্তাদের একাংশ অন্য দাবি করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, “একটা এলাইজা কিট এক বার খুললে সেটা দিয়ে একসঙ্গে পরপর ১০০টা টেস্ট করতেই হয়। না-হলে গোটা কিটটা নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হওয়ার ভয়েই কেউ দামি কিট কিনছে না।” তাঁদের আরও বক্তব্য, “গত বছরেই স্যাক্স-এ বড়সড় আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। চূড়ান্ত তদন্ত-রিপোর্টও জমা পড়েছে। তাই দামি জিনিস কিনতে হলেই স্যাক্স-কর্তারা ভয়ে পিছিয়ে আসছেন। ক্ষতির আশঙ্কা থাকছে রোগীদের।”
কিন্তু, ন্যাকো কেন কিট পাঠাতে দেরি করছে? ন্যাকোর কর্তাদের যুক্তি, প্রথমত, একাধিক সংস্থা সময়মতো তাদের কিট সরবরাহ করছে না। তার উপরে কত এলাইজা কিট লাগবে, সেটা স্যাক্স তাদের শেষ মুহূর্তে জানাচ্ছে। অত তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় সংখ্যক কিট পাঠানো যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য দফতরের খবর, কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক ও কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলির আওতায় একাধিক জেলার ব্লাড ব্যাঙ্ক আছে। ন্যাকো কিট পাঠালে এরা নিজেদের ভাগের কিট তুলে রেখে বাকি কিট জেলায় পাঠায়। কিন্তু কিটের এই আকালে তারা শুধু নিজেদের জন্য কিট কিনছে। জেলায় পাঠাচ্ছে না। এখন জেলার ব্লাড ব্যাঙ্কে কী ভাবে হেপাটাইটিস সি, এইচআইভি বা যৌন রোগ পরীক্ষা হচ্ছে, তাতে স্যাক্স-এর নজর নেই বলে অভিযোগ। |