এই সে দিনও তিনি দলের কাছে মূর্তিমান অস্বস্তি! কখন কী করবেন, কখন কী বলবেন তটস্থ আলিমুদ্দিন! সেই আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাই হাসপাতালে শুয়ে চাঙ্গা করে দিলেন সিপিএমের প্রতিবাদ! তাঁর উপরে হামলার প্রতিবাদে একজোট হয়ে পথে নামল উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং কলকাতা জেলা বামফ্রন্ট। ভাঙড়ে মঙ্গলবারের হামলার পরে যা এ বার রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছে সিপিএম।
রেজ্জাকের উপরে হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে এ দিন বালিগঞ্জ থেকে আলিপুর পর্যন্ত মিছিলের বহর নিশ্চিত ভাবেই স্বস্তি বাড়িয়েছে আলিমুদ্দিনের। মুখ্যমন্ত্রীর পাড়াতেই মাত্র এক দিনের নোটিসে জমায়েত এবং মিছিল সেই অর্থে তারকাখচিত না হয়েও যে আকার নিয়েছিল, সেটা ‘পরিবর্তনে’র রাজ্যে অন্য কোনও তাৎপর্য বয়ে আনছে কি না, এমন জল্পনাও শুরু হয়েছে। আলিপুরে প্রশাসনিক ভবনের কাছে জমায়েতে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “এই প্রতিবাদ এখন আর শুধু দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ব্যাপার নয়। গোটা রাজ্য জুড়ে আন্দোলন-কর্মসূচি হবে।”
পুলিশ সুপারের দফতরের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিতে আসার পথে ভাঙড়ের বামনঘাটায় বাম কর্মী-সমর্থকদের উপরে হামলার প্রসঙ্গ টেনে সূর্যবাবুর আরও ঘোষণা, “প্রতিবাদ এই শুরু হল মাত্র! এক দিন এই প্রতিবাদ গণ-প্রতিরোধের চেহারা নেবে!” বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু জানিয়েছেন, তৃণমূল-দুষ্কৃতীদের এ দিনের হামলা এবং প্রশাসনের ভূমিকার বিরুদ্ধে আজ, বুধবার বিকালে কলকাতা জেলা ফ্রন্টের মিছিল হবে ধর্মতলা থেকে কলেজ স্কোয়ার পর্যন্ত। যেখানে থাকবেন রাজ্য ফ্রন্ট নেতৃত্বও। রাজ্য জুড়ে হবে ধিক্কার মিছিল-সমাবেশ। |
ভাঙড়ে হামলার প্রতিবাদে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং কলকাতা
জেলা বামফ্রন্টের মিছিল। মঙ্গলবার দক্ষিণ কলকাতায় রাজীব বসুর তোলা ছবি। |
রেজ্জাক-ধাক্কা পৌঁছে গিয়েছে দিল্লিতেও। প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রীর উপরে হামলার প্রতিবাদে সোমবারই বিবৃতি দিয়েছিল পলিটব্যুরো। ভাঙড়ে এ দিনের ঘটনার পরে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট বলেছেন, “এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র নেই। পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূল বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করবে। আমরা সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে বলছি, রুখে দাঁড়াতে। বাংলায় হিংসার বিরুদ্ধে আমাদের দল গোটা দেশে প্রচার চালাবে।” ভাঙড়ের ঘটনার প্রতিবাদে আজ বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়েছেন রাজধানীর বাম নেতারা।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও কলকাতা জেলা ফ্রন্ট এবং বাম পরিষদীয় দলের প্রতিবাদে যোগ দিতে এ দিন আলিপুরে হাজির হয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার সিপিএম নেতৃত্বও। বামুনঘাটার ঘটনাস্থলে দক্ষিণের রতন বাগচি, রাহুল ঘোষদের আগেই দৌড়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক গৌতম দেব। এই সার্বিক ঐক্যের ছবিতে দেখা যায়নি শুধু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। আহত বিধায়ককে দেখতে হাসপাতালে বা তাঁর উপরে হামলার প্রতিবাদে কোনও কর্মসূচিতে বুদ্ধবাবুকে কেন দু’দিনেও প্রকাশ্যে দেখা গেল না, প্রশ্ন তুলেছে রেজ্জাক-ঘনিষ্ঠ শিবির। রেজ্জাকের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল নয় হলেই কি অন্তরালে রইলেন বুদ্ধবাবু?
দলেরই অন্য একটি অংশ অবশ্য বলছে, হাসপাতালে ছবি তোলার হুড়োহুড়ি সচেতন ভাবেই এড়িয়ে গিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু আলিমুদ্দিনে বসেই পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজ রেখেছেন রেজ্জাক-পর্বের যাবতীয় বৃত্তান্ত।
আলিপুরের সমাবেশ থেকে ফিরে সূর্যবাবুর নেতৃত্বে বাম প্রতিনিধি দল সন্ধ্যায় রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে দেখা করে রেজ্জাকের উপরে আক্রমণ-সহ এ দিনের ঘটনার সবিস্তার বিবরণ দেন। সূর্যবাবু পরে বলেন, “রাজ্যপাল জানিয়েছেন, তিনি হিংসার বিরুদ্ধে। পুরো বিষয়টি তিনি দেখবেন।” রাজ্যপালকে সূর্যবাবুরা লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, এ দিন তিন জন সিপিএম কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। যার মধ্যে এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহত ২৭ জন। আগুন লাগানো হয়েছে ১৩টি গাড়িতে। রাজ্যপালকে বাম প্রতিনিধিরা বলেন, পঞ্চায়েত ভোটের আগে তাঁরা আরও এই ধরনের ঘটনার আশঙ্কা করছেন। তাই অবিলম্বে তাঁর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কংগ্রেস কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ চাইলেও তাঁরা যে এর বিরুদ্ধে, তা ফের স্পষ্ট করে দিয়ে সূর্যবাবুর বক্তব্য, “আমরা কোনও দিনই কংগ্রেস বা তৃণমূলের মতো কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ চাইনি। আজও চাইছি না। আমরা তৃণমূলের নেতা-সহ দোষীদের অবিলম্বে শাস্তি চাই।”
বস্তুত, সিপিএম এখন যথাসম্ভব সতর্ক ভাবে দেখাতে চাইছে, তারা কত ‘দায়িত্বশীল’ বিরোধী দল। যেমন, এ দিনই দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দলের জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী বলে এসেছেন, সাগর মেলা চলছে বলে আপাতত তাঁরা বড় কোনও কর্মসূচি নিচ্ছেন না। কিন্তু ১৬ তারিখ সাগর মেলা ফুরিয়ে যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে প্রশাসনিক কোনও ব্যবস্থা না-হলে তাঁরা বড় আন্দোলনে যাবেন। এ দিনই আলিপুর পর্যন্ত মিছিল মুখ্যমন্ত্রীর খাসতালুক হাজরা হয়ে নিয়ে আসার পরিকল্পনা ছিল সিপিএমের। কিন্তু পুলিশের অনুরোধে মিছিল ঘুরে যায় রাসবিহারী দিয়ে। |