চোরের হানায় বিপন্ন মল্লরাজার গড়
মাটি চোরেদের থাবা পড়েছে মল্লরাজার গড়েও। রাজার গুমঘরের পাশ থেকে আগেই মাটি সরিয়ে ফেলেছে চোরেরা। পরিখাও মাটি ফেলে অনেক জায়গায় ভরাট করা হয়েছে। এ বার রাজার গড়ের দরজার তলা থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ভাবেই বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যবাহী বহু নির্দশন ধ্বংস হতে চলেছে।
পর্যটকদের কাছে বিষ্ণুপুরকে সাজানোর উদ্যোগ দূর অস্ত, স্থাপত্যগুলি রক্ষা করার কাজেও প্রশাসনের এই গা ছাড়া মনোভাবে ক্ষুদ্ধ শহরের বাসিন্দাদের একাংশ। তাঁদের আক্ষেপ, পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ তো বটেই, পুরকর্তৃপক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনের কর্তারা সব জেনেও না দেখার ভান করে রয়েছে।
মল্ল রাজবাড়ি ছিল পরিখাবেষ্টিত। পরিখার এক পাশে ছোট গড় দরজা। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ওই স্থাপত্য অধিগ্রহণ করেছে অনেক আগে। সম্প্রতি ওই গড় দরজার গা ঘেঁষে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। বাসিন্দারা জানান, রীতিমতো যন্ত্র দিয়ে মাটি সরানো হয়। তাঁদের আশঙ্কা, এতে গড় দরজার ভিত আলগা হয়ে পড়েছে। ফলে যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। পাশে থাকা পরিখার কিছু অংশ আবার মাটি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। রাধামাধব মন্দিরের (এটিও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দফতরের অধিগৃহীত) পিছনে কয়েক মিটার দূরে এ ভাবে পরিখা বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটি ঝুপড়ি তৈরি করা হয়েছে। খানিক দূরে রয়েছে গুমঘর। এর পাশ থেকেও মাটি কাটা হয়েছে।
রাজ পরিবারের সাত মহলের পাশেও এক সময় পরিখা ছিল। এখন তার বেশ কিছুটা অংশ ভরাট করা হয়েছে। সেখানেও নতুন বাড়িঘর নির্মাণের কাজ চলছে। রাজবাড়ি সংলগ্ন এলাকা জুড়ে এই ঐতিহ্য ধংসের কাজ চললেও প্রশাসনকে কখনও উদ্যোগী হতে দেখেননি বাসিন্দারা। এই এলাকাতে রয়েছে জোড়বাংলো, শ্যামরাই, রাধামাধব ও মৃন্ময়ী মন্দির। টেরাকোটার অপরূপ শিল্পকলা দেখতে আসা পর্যটকদের কাছে এই মন্দিরগুলির গুরুত্ব অনেকখানি।
ছবি: শুভ্র মিত্র।
গোড়ার দিকে তাই এই চত্বরেই বসত বিষ্ণুপুর মেলা। যা এখন জাতীয় মেলার স্বীকৃতি পেয়েছে। মেলায় বহু মানুষের সমাগম-সহ নানা কারণে মন্দিরগুলির ক্ষতি হচ্ছে, এই দাবি করে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ মেলা অন্যত্র সরাতে বলে। বাসিন্দাদের সঙ্গে পর্যটকদেরও প্রশ্ন, মেলা সরানো নিয়ে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ যে সক্রিয়তা দেখিয়েছিল, এখন মাটি চোরদের হাত থেকে এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যগুলি সংরক্ষণে তাদের সেই সক্রিয়তা কোথায়?
শুধু কী রাজবাড়ি সংলগ্ন এলাকাই নয়, মাটি কাটা হচ্ছে ছিন্নমস্তা এলাকার জোড় শ্রেণির মন্দির এলাকাতেও। অথচ পাশেই পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের নোটিস বোর্ডে উল্লেখ করা রয়েছে, ২০০ মিটারের মধ্যে কোনও রকম নির্মাণ করা বা জমি চরিত্র বদল করা যাবে না। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কলকাতা মণ্ডল এবং পূর্বাঞ্চল অধিকর্তা তপনজ্যোতি বৈদ্য বলেন, “আমাদের অধিগৃহীত এলাকার বাইরে ছোট দরজা ও বড় দরজার পাশে থেকে এক বছর আগে মাটি কাটা হয়েছিল। তখন আমরা জেলাশাসককে সে কথা বলার পরে মাটি কাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে যা খবর, তাতে এখন মাটি কাটা বন্ধই রয়েছে। আবার তেমন কিছু হলে আমি প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলব।” মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) অদীপকুমার রায় বলেন, “মাঝে মধ্যেই ওই সব মন্দির এলাকায় মাটি কাটা বা পরিখা ভরাটের অভিযোগ আসে। ভূমি দফতরকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।” মহকুমা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক রবীন্দ্রনাথ সরকারের দাবি, “কারা এ সব করছে, পুলিশকে বলেছি তদন্ত করে দেখতে।” বিষ্ণুপুরের উপ পুরপ্রধান বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, “সমস্যাটি যথেষ্ট উদ্বেগের। পুলিশকে দেখতে হবে।” এ সব ক্ষেত্রে ক’জনকে ধরেছে পুলিশ? সে তথ্য অবশ্য মেলেনি।
মাটি চোরের দাপট কিন্তু থেমে নেই। লালবাঁধ-সহ বিভিন্ন এলাকায় বিষ্ণুপুরের অন্যতম সৌন্দর্য লালমাটির ছোট টিলাও চোরেদের কোপে পড়েছে। লালজিউ মন্দিরের পিছনে দাঁড়িয়ে দুর্গাপুর থেকে আসা সুবিনয় ঘোষ তাঁর সঙ্গীকে বলছিলেন, “আগেও এসেছি। আগে এখানে কী সুন্দর একটা টিলা ছিল, সেটা এ বার দেখছি না।” ছোট গড় দরজার সামনে ছবি তুলছিলেন কলকাতা থেকে আসা এক দম্পতি। গড়ের পাশেই মাটি কাটা দেখে স্বামী স্ত্রীকে বলছিলেন, “পরের বার এসে এই দরজা আর দেখতে পাব বলে মনে হয় না।” এ ভাবে ইতিহাসই যদি ধ্বংস হয়, কীসের টানে বিষ্ণুপুরে আসবেন পর্যটকেরা? প্রশ্ন তুলেছেন ইতিহাসবিদ চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত। তাঁর আক্ষেপ, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ইউনেস্কোর কাছে বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলিকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য স্মারক’ হিসাবে ঘোষণার প্রস্তাব দিয়েছে। সেই বিষ্ণুপুরের এমন করুণ দশা ভাবাই যায় না।” তপনজ্যোতিবাবু বলেন, “অধিগৃহীত এলাকায় আমরা যথাসম্ভব নজরদারি রাখি। তবে কর্মীর সংখ্যা অপ্রতুল। নিয়মিত কর্মীও খুবই কম। চুক্তি ভিত্তিক কর্মীর উপরে নির্ভর করতে হয়েছে। শ্যামরাই, জোড়বাংলো এবং দোলমঞ্চের ক্ষেত্রে বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীর উপরে নির্ভর করছি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.