ঘটনার সূত্রপাত দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ। রেজ্জাককে মারধরে অভিযুক্ত আরাবুলকে গ্রেফতারের দাবিতে বালিগঞ্জ থেকে মিছিল করে গিয়ে আলিপুরে জেলা প্রশাসনের দরবারে ধর্নার যে কর্মসূচি সিপিএম নিয়েছিল, তাতে যোগ দিতে ৬০টি গাড়িতে কর্মী-সমর্থকেরা আসছিলেন। সামনের গাড়িতে ছিলেন দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সাত্তার মোল্লা। আবার এ দিন সকালেই কাঁটাতলা থেকে পাল্টা মিছিল করেছিলেন আরাবুল। সেই মিছিল শেষে ৪০-৫০ জন জড়ো হয়েছিলেন বামনঘাটায়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রথম পাঁচ-ছ’টি গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার পরেই তৃণমূলের লোকজন গাড়ি লক্ষ করে ইটবৃষ্টি শুরু করে। ছোড়া হয় বোমাও। পিছনের গাড়িগুলি দাঁড়িয়ে পড়ে। সিপিএমের গাড়িগুলি যাতে নিরাপদে ভাঙড় পেরিয়ে যেতে পারে, তার জন্য পুলিশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজা হয়েছিল। সোনারপুর, কাশীপুর, বারুইপুর, ভাঙড়, বাসন্তী থানা থেকে বাহিনী আনা ছাড়াও আলিপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশবাহিনী পাঠানো হয়। তাদের সামনেই শুরু হয় বোমাবাজি। জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, “ব্যারিকেড করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু হামলা রুখতে পারিনি।” |
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, রাস্তার দু’পাশ থেকে প্রচুর লোক এসে লাঠি-রড দিয়ে গাড়িগুলোতে ভাঙচুর চালাতে থাকে। ইট-বোমার মধ্যেই সিপিএম কর্মীরা গাড়ি থেকে নেমে এ দিক-ও দিক দৌড়তে থাকেন। অনেকে ঢুকে পড়েন গাড়ির নীচে। ঠিক তখনই গুলি চলে। কয়েক জন রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। একের পর এক আটটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আরাবুলের ছেলে, ভাঙড় মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হাকিবুলও গাড়িতে আগুন লাগান বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানিয়েছেন।
তৃণমূল সূত্রে খবর, সিপিএমের গাড়ি আটকাতে হামলা চালানোর ছক সোমবার রাতেই কষা হয়েছিল। কিন্তু এত গাড়ি যে এক সঙ্গে আসবে, সেই খবর আরাবুলদের কাছে ছিল না। গাড়িগুলি দাঁড়িয়ে যাওয়ায় প্রচুর সিপিএম কর্মী রাস্তায় নেমে পড়েন। আরাবুলের গাড়ি ছাড়াও আরও দুই তৃণমূল সমর্থকের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। তাতেই আতঙ্কিত হয়ে তৃণমূল কর্মীরা গুলি ছুড়তে শুরু করেন।
খবর পেয়েই সাত্তার মোল্লা গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থলে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, “এসে দেখি, গাছের আড়াল থেকে আরাবুল আর তার এক বেঁটে সঙ্গী গুলি চালাচ্ছে। আর ছ’জন রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। খবর নিয়ে জেনেছি, বেঁটে লোকটির নাম সামাদ মোল্লা।”
আহতদের পুলিশের গাড়ি ও অ্যাম্বুল্যান্সে করে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ জানায়, আহতদের নাম সুজিত দাস, মইদুল মোল্লা, হাসেম আলি মোল্লা, রহিম মোল্লা, মনসুর শিকারি ও হারুন ঘোষ মল্লিক। প্রথম তিন জনেরই গুলি লেগেছে। বছর সতেরোর সুজিতের অবস্থা গুরুতর। হারুন ও হাসেমকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সিপিএমের প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে আহতদের বাইপাসের ধারে দু’টি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
তৃণমূলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সহ-সভাপতি শক্তি মণ্ডল অবশ্য বলেন, “সোমবার রাতে বামনঘাটা এলাকায় আমাদের কিছু পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার প্রতিবাদে আরাবুলের নেতৃত্বে মিছিল হয়। আরাবুল মিছিল করে বামনঘাটায় দলীয় কার্যালয়ে বসে ছিলেন। সিপিএম তাঁকে মারধর করে রাস্তায় ফেলে দেয়। উনি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন। স্থানীয় কিছু সমর্থক তাঁকে মোটরবাইকে তুলে ঘটকপুকুরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। সেখান থেকে নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়েছে। শ্বাসকষ্ট রয়েছে। কথা বলার অবস্থায় নেই।”
আরাবুলের বয়ান অন্য রকম। তাঁর কথায়, “গাড়িতে ছিলাম। সিপিএমের গাড়ি থেকে গুলি চালাচ্ছিল। নীচে পড়ে গেলাম। তখনও গুলি চলছে। দলের ছেলেরা বাঁচায়।” প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অন্য একটি গাড়িতে চড়েই আরাবুল ঘটকপুকুরের দিকে যান।
হামলায় সিপিএম কর্মীদের একটা বড় অংশ ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা যে যার মতো এলাকা ছেড়ে পালান। পরে পুলিশ গিয়ে খালপাড়ে কয়েক জন সিপিএম কর্মীকে উদ্ধার করে। সিপিএম কর্মীদের নিয়ে ২০টা গাড়ি কলকাতার দিকে রওনা হয়। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক গৌতম দেব ঘটনাস্থলের দিকে যান। উত্তেজনা থাকায় পুলিশ তাঁকে বানতলা মোড়েই আটকে দেয়। |