আরাবুলই গুলি চালান, নালিশ সিপিএমের
কটা করে কাণ্ড ঘটান। দলীয় নেতৃত্ব পাশে দাঁড়ান। নেতৃত্বের বরাভয় পেয়ে আরও নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি! তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক এই আরাবুল ইসলামের সৌজন্যেই ভাঙড় আপাতত ভয়ঙ্কর!
দু’দিন আগে ভাঙড়ের কাঁটাতলায় হামলা হয়েছিল প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিএমের প্রবীণ বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার উপরে। মূল অভিযুক্ত আরাবুল। তাঁকে গ্রেফতার করার দাবিতে মঙ্গলবার আলিপুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ অবস্থান ছিল বামেদের। তার জন্য মিছিল করতে দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে বালিগঞ্জে আসার পথে সেই ভাঙড়েরই বামনঘাটায় আক্রান্ত হলেন সিপিএম কর্মীরা। পড়ল বোমা। গুলিবিদ্ধ তিন জন। এক কিশোরের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ বার আরাবুলের বিরুদ্ধেই গুলি ছোড়ার অভিযোগ! ঘটনাস্থলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অন্তত আটটি গাড়ি।
অগ্নিগর্ভ ভাঙড়। পরপর ট্রাক জ্বলছে রাস্তার ধারে। —নিজস্ব চিত্র
তৃণমূলের অবশ্য পাল্টা অভিযোগ, আরাবুল নিজেই আহত হয়েছেন। তিনি ভর্তি হয়েছেন চিনার পার্কের একটি নার্সিং হোমে। তাঁর গাড়িও ভাঙচুর হয়েছে।
ভাঙড়ের বুকে দিনদুপুরে তাণ্ডবের পরে মহাকরণে দাঁড়িয়ে তৃণূমূলের মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দরাজ ঘোষণা, “আরাবুল উদ্যমী ছেলে। খুব কাজের! মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, এত এনার্জি ও কোত্থেকে পায়! ভাঙড়ে রেজ্জাকের সঙ্গে লড়তে গেলে কি যুধিষ্ঠির দিয়ে হবে!” কিন্তু বিরোধীদের দিকে গুলি ছোড়া, তাদের গাড়ির উপরে হামলার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগের কী হবে? পার্থবাবুর জবাব, “আগে আরাবুলকে কে মারল, সেটা দেখি! বাকি পরে দেখব!”
হাসপাতালে আহতেরা। ইটের ঘায়ে জখম (বাঁ দিক থেকে তিন জন)।
বাকিদের কারও গুলি লেগেছে পেটে, কারও পায়ে।
তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা জানান, আরাবুলের ব্যাপারে আপাতত কিছু দেখা হবে না! তাঁর কথায়, “সামনে পঞ্চায়েত ভোট। জেলায় দুর্গ আগলাতে হবে। তার উপরে সংখ্যালঘু ছেলে, দলের পক্ষে কাজের।”
বস্তুত, ভাঙড়ের ঘটনার পরে এ দিন বাইপাসের ধারে তৃণমূল ভবন নয়, খাস মহাকরণেই মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীর্ঘ শলাপরামর্শ করে চার মন্ত্রী একযোগে জানিয়ে দিয়েছেন দলের বক্তব্য এবং দলীয় কর্মসূচি। বুঝিয়ে দিয়েছেন, দল ও সরকারের তফাত নিয়ে তাঁরা আদৌ ভাবিত নন! ক্ষমতায় এসে মমতা বলেছিলেন, মহাকরণ থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি চলবে না। কিন্তু তাঁর ১৯ মাসের জমানায় বাস্তব সেই ঘোষণার বহু দূর দিয়ে হেঁটেছে। তবু এ দিন যে ভাবে মহাকরণকে দলীয় মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত বলে বিরোধীদের অভিযোগ। রাজ্যপালের কাছে অভিযোগ জানিয়ে এসে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “অতীতে কোনও দিন এ জিনিস হয়নি! মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করার পরে মন্ত্রীরা মহাকরণ থেকে দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় মিছিল করা হবে। সাধারণ মানুষের কাছে এটা আতঙ্কের কারণ!”
অথচ এ দিনের ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় এবং এজিডি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। সন্ধ্যার পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র কেবল বলেন, “তদন্ত রিপোর্ট এখনও পাইনি। পেলে বলা যাবে।” তবে জানান, এ পর্যন্ত ১২-১৩ জন গ্রেফতার হয়েছে বলে তিনি জেনেছেন।

• বামনঘাটায় তৃণমূল-সমর্থকেরা জড়ো হলেন কেন?
• পাঁচ থানার পুলিশ থাকতেও গুলি-আগুন কী করে?
• এত ইট-বোমা কোথায় পেলেন তৃণমূল-সমর্থকেরা?
• রড-লাঠি নিয়ে আচমকা হামলাই বা কী ভাবে?
• সিপিএম-হানায় তৃণমূলের আহতেরা কোথায়?
• আরাবুল সরকারি হাসপাতালে গেলেন না কেন?
(রেজ্জাকের ক্ষেত্রে তৃণমূল একই প্রশ্ন তুলেছিল)
• পুলিশ বন্দুক বাজেয়াপ্ত করতে পারল না কেন?
• তৃণমূলের কর্মসূচি কেন মহাকরণ থেকে ঘোষণা?
• তদন্তের আগেই কেন ঘোষণা, আরাবুলই আক্রান্ত?
• প্রশাসনের তরফে ঘটনার পুরো বিবরণ নেই কেন?
• ধৃতেরা কোন দলের, তাঁদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?
সরাসরি আরাবুলের নাম না-করে সূর্যবাবুর অভিযোগ, “যিনি রেজ্জাক মোল্লার উপরে হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বই আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে এ দিন গুলি ছুড়েছেন!” যদিও স্বয়ং আরাবুল-সহ তৃণমূল নেতৃত্ব আগের দিনের মতোই গোটা ঘটনার দায় সিপিএমের উপরে চাপাতে চেয়েছেন। এবং সে জন্য প্রশাসনিক তদন্তের অপেক্ষা করেননি পার্থবাবুরা! শিল্পমন্ত্রীর কথায়, “সিপিএম গণতান্ত্রিক ভাবে বাতিল। তারা নীতিহীন হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে!” মহাকরণ থেকে বামেদের পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে, আরাবুলকে ‘ক্লিনচিট’ দিয়ে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন, আরাবুলই আক্রান্ত। সোমবার যিনি হাসপাতালে রেজ্জাককে দেখতে গিয়েছিলেন, সেই পার্থবাবুর দাবি, “আরাবুলের উপরেই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। আমাদের ১০ জন কর্মী আহত হয়েছেন।” যা শুনে সূর্যবাবুর মন্তব্য, “ওঁকে কে আক্রমণ করবে? তৃণমূলে কেউ থাকতে পারে, বিরোধীদের নেই!”
ভাঙড়ের ঘটনা শোনার পরে এ দিন অসুস্থ শরীর নিয়েই মহাকরণে চলে আসেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমে প্রশাসন এবং পরে দলের কয়েক জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে দু’পক্ষের অভিযোগ নিয়ে প্রশাসন কার্যত কোনও কথা না-বললেও মহাকরণের প্রেস কর্নার থেকে দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন পার্থবাবু, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ, অরূপ বিশ্বাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং দলের প্রথম সারির নেতারা। পার্থবাবু বলেন, “১০ থেকে ১৮ জানুয়ারি সিপিএম এবং কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের যৌথ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়ে সন্ধ্যে ৬টার পরে প্রতিবাদে নামব। ১৮ তারিখ কেন্দ্রীয় মিছিল হবে।” আজ, বুধবার বামনঘাটায় সকাল ১১টায় সভা করবে তৃণমূল। সেখানে মুকুল রায়-সহ তৃণমূলের অন্য নেতারা থাকবেন।
অশান্তি দিনভর

সকাল ১০টা
কাঁটাতলায় আরাবুলের নেতৃত্বে মিছিল

বেলা সাড়ে ১২টা
বামনঘাটায় সিপিএমের গাড়িতে ইটবৃষ্টি, বোমা

দুপুর ১টা
গুলিবিদ্ধ তিন, জখম ৬, আগুন লাগানো হল ৯টি গাড়িতে দেড়টা
আরাবুলকেও মারধর করে গাড়িতে ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ

পৌনে ২টো
জখম সিপিএম কর্মীদের হাসপাতালে নিয়ে গেল পুলিশ

পৌনে ৩টে

আরাবুল ভর্তি হলেন বাগুইআটির নার্সিংহোমে

আরাবুল উদ্যমী ছেলে। খুব কাজের।
ভাঙড়ে রেজ্জাকের সঙ্গে লড়তে
গেলে কি যুধিষ্ঠির দিয়ে হবে!
পার্থ চট্টোপাধ্যায়

যিনি রেজ্জাক মোল্লার উপরে হামলায়
নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই খ্যাতিসম্পন্ন
ব্যক্তিই এ দিন গুলি ছুড়েছেন।
সূর্যকান্ত মিশ্র
২৪ ঘণ্টা আগে হাসপাতালে গিয়ে যাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে এসেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে পার্থবাবুর অভিযোগ, “বিছানায় শুয়ে রেজ্জাক প্ররোচনা ছড়াচ্ছেন। বিগত দিনে তাঁর বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি অভিযোগ সকলের জানা।”
শিল্পমন্ত্রী বলেন, “আরাবুলের উপরে যে ভাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা হয়েছে, আমরা জানতে চাই এত অস্ত্র এল কোথা থেকে? প্রশাসনের কাছে আমরা এই দাবি জানিয়েছি।”
কিন্তু গুলি কারা চালাল, আগুনই বা কারা লাগাল, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে শিল্পমন্ত্রী বলেন, “এ সব তো প্রশাসন দেখবে। পুলিশকে বলা হয়েছে। পুলিশের যদি কোনও গাফিলতি থাকে, সেটাও দেখা হবে।” লাভপুরে মুকুলবাবু বলেছেন, “আলিপুরের একটি সভায় অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার সময়ে সিপিএম কর্মীরা ধরা পড়েছেন। ভাঙড়ে গুলি চলেছে। সিপিএমের দুষ্কৃতীরা রাজ্যে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে চাইছে। তা বরদাস্ত করব না।” শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু পুরুলিয়ায় বলেছেন, “কে বা কারা গুলি চালিয়েছে, সেটা তদন্তসাপেক্ষ। যে-ই গুলি চালাক, তা নিন্দনীয়।”
এ দিন ভাঙড়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠি। সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর দাবি, “যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁরা সকলেই আমাদের দলের। কেউ কেউ গাড়ির চালক! যাঁদের গাড়ি আজ আগুনে পুড়েছে। অথচ অভিযুক্তেরা কেউ ধরা পড়ল না!”
আরাবুলের সমর্থনে চার মন্ত্রী। মঙ্গলবার মহাকরণে সুব্রত মুখোপাধ্যায়,
অরূপ বিশ্বাস, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিম।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম দেবের প্রশ্ন, “একের পর এক গাড়ি জ্বলল সিপিএমের। একের পর এক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন সিপিএমের লোকজন। আর আমরাই আক্রমণ করলাম?”
এই ঘটনার পরে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রের দ্বারস্থ হবে কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বিশেষ প্রতিনিধি দল পাঠানোর অনুরোধ করবেন তাঁরা। প্রদীপবাবুর কথায়, “সব দলেরই সংযত হওয়া উচিত। কিন্তু প্রথমে তৃণমূলের সংযত হওয়া উচিত। কারণ তারা শাসক।” অন্য দিকে, বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিন্হা ভাঙড়ে সেনা নামানোর দাবি তুলেছেন! ভাঙড়-কাণ্ড নিয়ে আজ, বুধবার রাজ্যপালের কাছেও যাবেন তাঁরা।

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.