পঁচাত্তরের পাঁচ গোলে হারের লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে চৌত্রিশ বছর লেগেছিল মোহনবাগানের।
ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের সঙ্গে তর্কের সময় এতদিন বাগান সমর্থকরা যে ‘গর্ব’ সামনে এনে দুয়ো দিতেন, যে আমরা অন্তত আর যাই হোক দ্বিতীয় ডিভিসনে খেলিনি। সেটাও বোধহয় এ বার ধুলিসাৎ হতে চলেছে!
১৯২৯-’৩১ তিন বছর কলকাতা লিগের দ্বিতীয় ডিভিসনে খেলেছিল ইস্টবেঙ্গল। সেই কালি এ বার লাগতে চলেছে সম্ভবত গঙ্গাপারের ক্লাবেও। ডার্বি ম্যাচে দল তুলে নেওয়ার জন্য নির্বাসন-কলঙ্কের সঙ্গে আই লিগের দ্বিতীয় ডিভিসনে খেলাও প্রায় ভবিতব্য মনে হচ্ছে বাগানের। ফেডারেশন সূত্রের খবর, ১৫ জানুয়ারি কর্মসমিতির সভায় মোট শাস্তি থেকে, দু’বছর শাস্তি কমলেও কমতে পারে। কিন্তু টোলগেদের দ্বিতীয় ডিভিসনে খেলা আটকানো দুঃসাধ্য। যদি না ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল পটেল শেষ মুহূর্তে পরিত্রাতার ভুমিকায় অবতীর্ণ হন। শোনা যাচ্ছে এ দিনও পটেল বলেছেন, আইন যা আছে তার বাইরে তিনি যাবেন না।
মোহনবাগানের জন্য অবশ্যই তা মধুর সঙ্গীত নয়।
নির্বাসন থেকে বাঁচতে বেশ কিছুদিন হল প্রফুল্লের দ্বারস্থ হয়েছেন মোহনবাগান কর্তারা। কার্যত নতজানু হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন আড়াই বছরের নির্বাসন থেকে বাঁচতে। দিল্লির ফেডারেশেন সূত্রের খবর, মোহনবাগানের ঐতিহ্য, আভিজাত্য এবং বিশাল জনসমর্থন বিবেচনায় প্রাপ্য শাস্তি থেকে দু’বছর কমিয়ে দেওয়া হতে পারে। কর্মসমিতির সদস্যরা তাতে হয়তো বাধা দেবেন না। কিন্তু তাতেও তো ছ’মাসের শাস্তি থেকে গেল। সেটাও তো মারাত্মক। |
এ বছর বাকি আই লিগে নির্বাসিত হলে পয়েন্ট শূন্য হয়ে যাবে করিম বেঞ্চারিফার দলের। সেই দলকে কী ভাবে আই লিগে খেলার সুযোগ দেবে ফেডারেশন? যদি সেটা করা হয় তা হলে গোয়া-সহ আই লিগের অন্য ক্লাবগুলি বেঁকে বসতে পারে। সেই চাপ ক্লাবগুলো ইতিমধ্যেই দিতে শুরু করেছে। গোয়ার একটি ক্লাব তো ইতিমধ্যেই মৃদু হুমকি দিয়েছে, মোহনবাগানকে ছেড়ে দেওয়া হলে সেটা খুব খারাপ দৃষ্টান্ত হবে। এরপর তা হলে নিজের মাঠে তারা পিছিয়ে পড়লে নিজেদের সমর্থক দিয়ে ইট মেরে খেলা ভেস্তে দেবে। এরপর কর্মসমিতিতে এসে ক্ষমা চাওয়ার চিঠি দিয়ে শাস্তি কমাবে।
ফেডারেশনের এক কর্তা মঙ্গলবার বলে দিলেন, “আই লিগের ক্লাবগুলো সবাই মিলে একটা নিয়ম ঠিক করেছে। মোহনবাগানও সেখানে সম্মতি জানিয়েছিল। সেই নিয়মই যদি বদলানো হয় তা হলে বড় সমস্যা তো হবেই। অবনমনে পড়ে যাওয়া অন্য টিম গুলোও তখন ঝামেলা পাকাবে।”
প্রশ্ন হল ফেডারেশনের কর্মসমিতির কি মোহনবাগানের অবনমন বাঁচানোর ক্ষমতা আছে? ফেডারেশনের আইনজীবী উষানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “কর্মসমিতি সংস্থার সর্বোচ্চ অ্যাপিল বডি। তারা যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু যা করতে হবে নিয়মের মধ্যে থেকেই।” এর বাইরে আর কিছু বলতে চাননি খেলার মাঠের নিয়ম-জানা, পরিচিত আইনজীবী উষাবাবু। তবে জানা গিয়েছে, নিয়মের মধ্যে থেকে মোহনবাগানের শাস্তি কতটা কমানো যায় তা নিয়ে ফেডারেশন খোঁজ খবর নিচ্ছে তাদের আইনজীবীদের কাছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত যা খবর, তাতে মোহনবাগানকে দ্বিতীয় ডিভিসন থেকে বাঁচানোর কোনও পথ খুঁজে পাননি তাঁরা। বড় জোর কিছুদিন স্থগিত রাখা যায় পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার জন্য। তারপর অবশ্য সেই অপ্রিয় সিদ্ধান্তই নিতে হবে। |
দুর্গাপুরে সতীর্থদের সঙ্গে অনুশীলনে মোহনবাগানের ওডাফা। —নিজস্ব চিত্র। |
জানা গিয়েছে, ১৫ জানুয়ারি কর্মসমিতির সভায় যেমন ডাকা হচ্ছে টুটু বসু-অঞ্জন মিত্রদের তেমনই রাখা হচ্ছে ফেডারেশনের আইনজীবীদের। তবে আইনের যে কচকচানিই চলুক শেষ কথা বলবেন কিন্তু প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল পটেল। তিনি এখন লন্ডনে। ফিরবেন রবিবার রাতে। এরপর থেকেই নাটক জমবে। পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
মোহনবাগানের লাইফ লাইন একটাই। তা হল, পরের আই লিগ থেকে এয়ার ইন্ডিয়া ও ওএনজিসির চলে যাওয়া। কারণ দুটি অফিস দলই এ এফ সি-র গাইড লাইন মানতে পারেনি। মোহন কর্তাদের আশা, এখন না হলেও জুন-জুলাইতে ওই দুটি দলের একটির জায়গায় তারা আই লিগে ঢুকে যাবে। এমনিতেই আই লিগের অবস্থা রমরমা নয়। তারপর সমর্থন বিশিষ্ট এতবড় ক্লাব চলে গেলে জৌলুস আরও কমবে।
প্রথম জাতীয় লিগের যোগ্যতানির্ণায়ক খেলায় জিততে পারেনি মোহনবাগান। শতাব্দীপ্রচীন ক্লাবকে বাঁচাতে মাঠে নেমেছিলেন তৎকালীন ফেডারেশেন প্রেসিডেন্ট প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। ‘গ্রিন কার্ড’ দিয়ে বাগানকে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। প্রশ্ন হল, বরাবর নিয়ম মেনে চলা প্রফুল্ল কি সেটা করবেন? ফেডারেশনের এক কর্তা বললেন, “প্রফুল্লর সঙ্গে এতদিন কাজ করছি। কখনও কিছু জোর করে চাপিয়ে দেননি। তবে দেশটার নাম তো ভারত। এখানে সবই হয়।”
মোহনবাগান কর্তারা অবশ্য পুরো বিষয়টি নিয়ে একেবারেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এ দিনই দুর্গাপুরের আবাসিক শিবিরে ফের চোট পেয়েছেন টোলগে ওজবে। আর এক স্ট্রাইকার ওডাফা ওকোলিও এক বছর নির্বাসনের পথে। ১৫ জানুয়ারির পর যে কোনও দিন শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির সভা ডেকে ওডাফার শাস্তির নিদান দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে তীব্র চাপে সবুজ-মেরুন কর্তারা। তাঁরা সবাই তাকিয়ে প্রফুল্ল পটেলের দিকে। ক্লাবের কলঙ্কজনক শাস্তির পর তাঁদের অবস্থা সত্যিই করুণ।
ইস্টবেঙ্গল কর্তারা কি বলছেন? তারা আপাতত চুপচাপ। তবে বাগানের রথচক্র মেদিনী গ্রাস করছে এই অবস্থায় তাঁরা বিশেষ দুঃখিত নন!
|
মোহনবাগানের বিরুদ্ধে যা গিয়েছে |
• কর্তারা যাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা টিভিতে ম্যাচ দেখছিলেন। কেউ মাঠে ছিলেন না। বাস্তব পরিস্থিতি তাঁরা জানতেনই না।
• পুলিশ রিপোর্টে বলা রয়েছে বিশৃঙ্খলা এমন পর্যায়ে কোনওসময়ই পৌঁছয়নি যাতে ম্যাচ বন্ধ করে দিতে হয়।
• রাজ্যের চার মন্ত্রী মাঠে হাজির ছিলেন। তাঁরা এবং সর্বোচ্চ পুলিশ কর্তাদের অনুরোধ বাগান প্রত্যাখান করে। মাঠে থাকা ফুটবল সচিব উত্তম সাহা-র সঙ্গে আলোচনার সময় ফোন এলে তিনি বেরিয়ে যান। সন্দেহ— ফোনটা মাঠে না থাকা কর্তাদের থেকে এসেছিল।
• এক সদস্যের কমিশনের রিপোর্টও দ্বিধাহীনভাবে মোহনবাগানের বিপক্ষে গিয়েছে।
• প্রেসিডেন্ট নরমপন্থী হলেও আইন এতটাই পরিষ্কার যে সম্পূর্ণ বাঁচাতে চাইলে অন্য বড় ক্লাব বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। |
|