একুশ মাস পূর্ণ হইয়াছে, ষাট হাজারের বেশি প্রাণ বিসর্জন গিয়াছে। একুশ মাস আগে যাহা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হিসাবে শুরু হইয়াছিল, আন্দোলন সূচনার অনতিপরেই সেখানে রাষ্ট্রীয় হিংসার ভয়াবহতা প্রায় সর্ব কালের রেকর্ড ছাড়াইবার উপক্রম করিয়াছে। সমাজের সামরিক ও অসামরিক সকল অংশের উপর, নারী-শিশু-বয়স্ক নির্বিশেষে, বিদ্রোহদমনের নামে সরকারি জিঘাংসার করাল ছায়া লাগাতার বিরাজমান রহিয়াছে আজ দেড় বৎসর যাবৎ। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দেশে যখন এহেন পরিস্থিতি, প্রেসিডেন্টকে কিন্তু বড় একটা দেখা যায় নাই। গত ছয় মাসে এক বারও তিনি প্রকাশ্যে বাহির হন নাই, তাঁহার একটিও বার্তা কিংবা প্রতিক্রিয়া শুনিতে পাওয়া যায় নাই। এই বিস্ময়কর নিশ্ছিদ্র নীরবতা শেষ পর্যন্ত ভঙ্গ হইল গত রবিবার: প্রকাশ্য বক্তৃতায় আসাদ জানাইলেন নূতন সংবিধান ও নূতন মন্ত্রিসভা গঠন করিয়া সিরিয়ার সংকট-মুক্তির ব্যবস্থা করিতে তিনি এই মুহূর্তে ব্যস্ত। ছয় দফা প্রস্তাবের মাধ্যমে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের পরিকল্পনায় ব্যাপৃত। উল্লেখ্য, এই প্রস্তাবসমূহের মধ্যে বিরোধীদের সহিত বোঝাপড়ার প্রয়াসের কিন্তু সুদূরতম ইঙ্গিতটিও নাই।
দুর্ভাগ্য, যত দফা প্রস্তাবই দিন, প্রেসিডেন্ট আসাদের বহু-প্রতীক্ষিত বার্তা আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় আশালোক জ্বালাইতে পারিল না, বরং হতাশা ও বিরক্তিতে নূতন ইন্ধন জোগাইল। রাষ্ট্রপুঞ্জ হইতে শুরু করিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন, সকলেরই মতে, বিদ্রোহীদের সহিত একত্র বসিয়া বোঝাপড়ার কোনও আশ্বাস প্রেসিডেন্ট আসাদের প্রস্তাবে নাই, এবং সেই অর্থেই এই প্রস্তাব ‘অমানবিক’, ইহা সমর্থন করার প্রশ্নই উঠে না। গত একুশ মাস যাবৎ বিদ্রোহ আন্দোলন যে ভাবে অবিচ্ছিন্ন ভাবে জারি থাকিয়াছে, যে বিরাট পরিমাণ মূল্য সিরীয় সমাজকে দিতে হইয়াছে, যত মানুষের অংশগ্রহণ ও বলিদান এই বিদ্রোহের পরতে পরতে জড়াইয়া গিয়াছে, তাহাতে প্রতিবাদী পক্ষকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া আজিকার এই একতরফা সমাধান প্রস্তাব একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এমন প্রস্তাবের সাফল্যের সম্ভাবনাও একই কারণে অত্যল্প: শূন্য বলিলেই চলে।
প্রত্যাশিত ভাবেই, প্রেসিডেন্ট আসাদের দৃঢ় সমর্থক হিসাবে সামনে আগাইয়া আসিয়াছে ইরান। তেহরানের চোখে, প্রেসিডেন্ট আসাদ ‘শান্তি পরিকল্পনা’র নীল নকশা দিয়াছেন, ‘সন্ত্রাসবাদী’রা যেন তাহা মানিয়া লয়। প্রসঙ্গত, দামাস্কাস ও তেহরান যুগ্ম ভাবে এ যাবৎ বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়া আসিতেছে, দাবি করিতেছে কতিপয় পশ্চিমি শক্তির প্রচ্ছন্ন মদতে সন্ত্রাসবাদীরা সিরিয়ায় নৈরাজ্যসাধনায় নিরত। বুঝিতে অসুবিধা নাই, ইরান-সিরিয়ার সহিত পশ্চিমি দুনিয়ার দূরত্ব আসাদের এই নূতন বক্তব্যে আরও অনেকটা বর্ধিত হইল। এই তীব্রবিভক্ত পরিস্থিতিতে এ বার মিশর, তুরস্কের মতো দেশগুলি কী অবস্থান লয়, তাহার উপর নির্ভর করিবে পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি তথা সিরিয়াবাসীর প্রাত্যহিক সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নটি। |