পশ্চিমবঙ্গের প্রতি চাহিয়া সত্যই বিস্ময়ের শেষ নাই। আমরা বনাম উহারা-র দ্বন্দ্বের ধারাবাহিক সাধনা দেখিতে দেখিতে বঙ্গবাসী যখন হা-ক্লান্ত, মহাকরণ হইতে আমাদের (উহাদের) নিষ্ক্রমণ এবং উহাদের (আমাদের) প্রবেশের পরেও যখন সেই বিভাজন সমান প্রবল এবং হয়তো বা কিঞ্চিৎ অধিক প্রকট, তখন স্বভাবতই মনে হইয়াছিল, এই বিষয়ে যাহা বলিবার ছিল সকলই বলা হইয়া গিয়াছে, যত দূর দেখিবার ছিল তত দূর দেখা হইয়া গিয়াছে। ভুল। গত সপ্তাহে টের পাওয়া গেল, ছবি এখনও বাকি আছে। রাজ্য সরকার হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ হইতে একটি মামলা প্রত্যাহার করিয়া লইল। সংক্ষেপে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত: মেট্রো রেলের পূর্ব-পশ্চিম সম্প্রসারণের প্রকল্পে অন্যতম বাধা উপস্থিত হয় একটি স্টেশন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমির সূত্রে; ওই জমি লইয়া মামলা হয়, আদালত স্থগিতাদেশ জারি করে, রাজ্য সরকার তাহার বিরুদ্ধে আপিল করে; মামলা চলিতেছিল, এই অবস্থায় রাজ্য সরকারের মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত। কেন এই মত বদল? কারণটি সহজ এবং সরল। আগে তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারের শরিক ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরে তাঁহার অনুগামীরা রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ সম্পন্ন করিবার জন্য রাজ্য সরকার তৎপর হইয়াছিল, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আপিল সেই কারণেই। ইতিমধ্যে গাঁটছড়া খুলিয়া গিয়াছে, ‘আমাদের’ রেল মন্ত্রক এখন ‘উহাদের’ হইয়াছে, সুতরাং রাজ্য সরকার হাত ধুইয়া ফেলিতে তৎপর।
পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যে ইহার ফলে বিশ বাঁও জলে পড়িল? তাহাতে রাজ্য সরকারের কী আসে যায়? রাজ্য সরকার তো তৃণমূল কংগ্রেসের। ঠিক যেমন, রেল তো কংগ্রেসের, যে কংগ্রেস আবার অধীর চৌধুরীকে মন্ত্রীর পদে বসাইয়াছে, যে অধীর চৌধুরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবলতম এবং সরবতম বিরোধীদের এক জন। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার অনুগামীরা এই সব গুরুতর অঙ্কগুলি না কষিয়া কলিকাতার যাত্রীদের কথা, পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের কথা, এই সকল তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় ভাবিয়া সময় নষ্ট করিবেন? তাঁহারা কি নাবালক নাকি? তাঁহারা ঝানু রাজনীতিক। তাঁহারা জানেন, মেট্রো রেলের এই নবপর্যায়টি যদি দ্রুত অগ্রসর হয়, তাহা হইলে অধীরবাবু ও তাঁহার দলের নামযশ হইবে, তাঁহারা সেই নাম এবং যশ ভোটের প্রচারে ব্যবহার করিবেন। সেই সুযোগ কি তাঁহাদের করিয়া দেওয়া যায়? বরং মেট্রোর কাজ বিলম্বিত বা বিপর্যস্ত হইলে মুখ্যমন্ত্রী যথাকালে আবেগের পর্দা ক্রমশ চড়াইয়া বলিতে পারিবেন, তাঁহার ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ উহারা নষ্ট করিয়া দিল, সাজানো বাগান শুকাইয়া দিল। এই ৩ জানুয়ারি আদালতে মামলা প্রত্যাহার করিয়া তাঁহার সরকার নিজেই যে কফিনে একটি বড় মাপের পেরেক ঠুকিয়া দিয়াছিলেন, সে কথা আর কে মনে রাখিবে? জনস্মৃতি দুর্বল, ভোটের বাজারে দুর্বলতর।
অথচ প্রত্যাশিত ছিল ইহাই যে, রাজ্যের স্বার্থে, রাজ্যের মানুষের পরিবহণ ব্যবস্থায় উন্নতির স্বার্থে কেন্দ্র এবং রাজ্য, প্রয়োজনে পুরসভার সহযোগিতায় একযোগে সম্ভাব্য সমস্যাগুলি দূর করিতে তৎপর হইবে। সমস্যা তো কেবল এই একটি স্টেশন লইয়া নয়। আরও নানা স্থানে সম্প্রসারণের পথে বাধা আছে। ঠিক যেমন বড় আকারের বাধা রহিয়াছে মেট্রো রেলের অন্য সম্প্রসারণ প্রকল্পগুলিতেও। সেই সব বাধা দূর করিবার জন্য যেমন প্রশাসনিক স্তরে সহযোগিতা জরুরি, তেমনই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যেও সহযোগিতার প্রয়োজন হইতে পারে। বিশেষত, জমির অধিকার লইয়া যখন বিবাদ বাধে, তখন প্রকৃত সর্বদলীয় উদ্যোগে সমাধানের চেষ্টা করিতে পারিলে গণতন্ত্রও মর্যাদা পায়, কাজও সহজ হয়। তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনাবলি পশ্চিমবঙ্গে স্বাভাবিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বামফ্রন্ট জমানার বিষবৃক্ষ তৃণমূল কংগ্রেস জমানায় উচ্চফলনশীল হইয়াছে। ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো তাহার এক উৎকট নজির। অতঃপর, অনুমান করা যায়, এই প্রকল্পটি লইয়া অধীর চৌধুরী বনাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তরজা জমিয়া উঠিবে। বঙ্গবাসী নিরুপায় শ্রোতা। অসহায় দর্শকও। |