টানা ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্বর্ণ ধানের চাষ হয়ে আসছে বীরভূমে। প্রথম দিকে কদর ছিল ওই ধানের। ঠিকঠাক দামও পেতেন চাষিরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ওই ধানের বাজার কমে গিয়েছে। ফলে ওই ধানের অভাবী বিক্রি রুখতে গত কয়েক বছর থেকে রাজ্য সরকার ধানের দর বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না বলেই অভিযোগ। কারণ অধিকাংশ চালকল মালিকই এখন আর ওই ধান পছন্দ করছেন না। শুধুমাত্র সরকারি লেভি বাবদ যে চাল প্রয়োজন, তার বেশি ধান সরকারি নির্ধারিত দরে কিনতে আগ্রহী নন তাঁরা। ওই চালকল মালিকদের দাবি, মোটা স্বর্ণধানের বাজার বীরভূম ও আশপাশের জেলাগুলিতে নেই বললেই চলে। এক চালকল মালিকের বক্তব্য, “এখনও ওই চালের বাজার রয়েছে মূলত অসমে। আর কিছুটা শিলিগুড়ি ও বিহারে। কিন্তু সে সব জায়গায় চাল নিয়ে যাওয়ার খরচ অনেক। ফলে চাষিদের থেকে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে কম দরে অতিরিক্ত ধান কেনা ছাড়া কোনও উপায় নেই।”
উপায় নেই চাষিদেরও।
চাহিদার থেকে উৎপাদন বেশি হওয়ায় এবং অন্যত্র ধান বিক্রির ব্যবস্থা না থাকায় চাষিরা বিভিন্ন আড়তদারের মাধ্যমে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে জেলা কৃষি দফতরকে। বিগত কয়েক বছর ধরেই বিকল্প প্রজাতির ধান চাষ করার জন্য চাষিদের উৎসাহিত করছে কৃষি দফতর। জেলা কৃষি আধিকারিক প্রদীপ মণ্ডল জানিয়েছেন, গত বছর ১০:১০ ধানের চাষ শুরু হয়েছে। হায়দ্রাবাদ থেকে ওই ধানের বীজ আমদানি করা হয়েছে। তাঁর দাবি, “ওই ধানের চাল সরু এবং চাষের জন্য সময়ও কম লাগে। কিন্তু স্বর্ণধানের মত উচ্চ ফলনশীল নয়। তবে ওই ধান বা চালের বাজার রয়েছে।” গত বছর জেলার ৮টি জায়গায় ৮০০ হেক্টর জমিতে ওই ধানের চাষ হয়েছে। এ বছর বোরোতেও ওই ধানের চাষ করার জন্য ৬টি এলাকা বেছে নেওয়া হয়েছে। তাতে ১০০ হেক্টর জমিতে চাষ হবে বলে মনে করছেন প্রদীপবাবু। এরপরেও তাঁর অভিমত, “এক দিনেই স্বর্ণধানকে প্রত্যাহার করা যায় না। কয়েক বছর সময় লাগবে।”
তবে আশার কথা হল, বহু চাষিই এখন স্বর্ণধান বাদ দিয়ে নতুন প্রজাতির উন্নত মানের ধান চাষ করতে আগ্রহী। বোলপুরের সালোন গ্রামের প্রখ্যাত প্রবীণ চাষি মালেক মণ্ডল বলেন, “অনেক আগে রঘুশাল, ভাসামানিক পরে রত্না ধানের চাষ হত। কিন্তু যে কোনও প্রজাতির ধান ১৫ বছরের বেশি হলে উৎকর্ষতা হারায়। স্বর্ণধানও উৎকর্ষতা হারাতে বসেছে।” কিন্তু আমদানি করা ১০:১০ ধানের বীজও প্রয়োজন মতো পাওয়া যাচ্ছে না বলে তাঁর দাবি।
অন্য দিকে, এ বার রাজ্য সরকার স্বর্ণধানের দাম বেঁধে দিয়েছে ১২০০ টাকা প্রতি কুইন্ট্যাল। জেলায় খোলা বাজারে প্রতি কুইন্ট্যাল ৯৫০-১০০০ টাকায় বহু চাষিই ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। এই তথ্য মেনে নিয়েছেন বোলপুরের বাসিন্দা রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহও। তবে তাঁর দাবি, “দু’ একটি কৃষি সমবায় সমিতি সহায়ক মূল্যে ধান কিনছে বলে শুনেছি।” চালকল মালিকদের অবশ্য দাবি, তাঁরা এখনও সরকার নির্ধারিত দরেই চাল কিনছেন। তাঁরা এও জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধানের বেশি তাঁরা আর ধান কিনতে পারবেন না।
বোলপুরের প্রবীণ চালকল মালিক তথা সারা ভারত চালকল সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি সুশীল চৌধুরী বলেন, “দু’ তিনটি জেলা ছাড়া রাজ্যে প্রায় দেড় লক্ষ টন স্বর্ণধান উৎপাদিত হয়েছে। রাজ্যে চালকলই আছে প্রায় ১১০০টি। সে ক্ষেত্রে অত ধান কেনা চালকল মালিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। তার সব থেকে বড় কারণ ওই চালের বাজার নেই।” তাই স্বর্ণধানের পরিবর্তে বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে বাজার চলতি সরু ধান আমদানি করাতেই চালকলগুলি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। সুশীলবাবুর অভিযোগ, “স্বর্ণধান বাদ দিয়ে নতুন প্রজাতির উৎকৃষ্ট মানের ধান চাষ করার জন্য রাজ্য সরকারকে গত কয়েক বছর ধরে লিখিতভাবে জানানো হচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হচ্ছে না।” যার নিট ফল, একদিকে যেমন চালকল মালিকদের কোনও উপায় নেই, তেমনই মার খাচ্ছেন চাষিরাও। যদিও বেনফেডের জেলা ম্যানেজার ইদনে ইনামের আশ্বাস, “সরকারি দরে জেলার বিভিন্ন কৃষি সমবায় সমিতি থেকে ধান কেনা হবে। সেই ধান সংশ্লিষ্ট চালকলগুলিতে চাল তৈরি করে কেন্দ্রীয় সরকারের ফুড কর্পোরেশনে দেওয়া হবে।” জেলা প্রশাসন আগেই জানিয়েছিল, কৃষি সমবায় সমিতিগুলি থেকে মঙ্গলবার থেকে ধান কেনা শুরু হবে। কিন্তু ঘটনা হল মঙ্গলবারও তা শুরু হয়নি। বেনফেড সূত্রে খবর, বহু সমবায় সমিতিই ধান কিনতে রাজি হচ্ছে না। শুধু মাত্র নলহাটি ১ ও ২ ব্লকেই এমন সমিতির সংখ্যা প্রায় ৪০টি। তারা কেউই আগাম টাকা দিয়ে ধান কিনতে রাজি নয়। যদিও নলহাটিরই কয়থা কৃষি সমবায় সমিতি দেড় কোটি টাকার ধান কিনবে বলে জানিয়েছেন ওই সমিতির ম্যানেজার সফিকুল আলম। আজ, বুধবার থেকে সেখানে ধান কেনা শুরু হবে। |