|
|
|
|
|
নিউ ইয়র্ক শহর মনীষা আর আমি
ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল স্লোন কেটরিং ক্যানসার সেন্টারে এক মাসের
ওপর চিকিৎসাধীন মনীষা কৈরালা। বছরের প্রথম দিন যন্ত্রণাকাতর
সহকর্মীকে দেখে এসে লিখছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত |
|
বছরের প্রথম দিন। নিউ ইয়র্ক শহরে আমি।
মনে অনেক আশার রোমাঞ্চ। আবার অব্যক্ত যন্ত্রণাও। সামনে না-খোলা চিঠির মতো পড়ে আছে ২০১৩। আশ্চর্য রহস্যময়। ঠিক তেমনই এক বুক দুরুদুরু মিশ্র অনুভূতি তখন অন্য কারণে। কারণ আমি দেখা করতে চলেছি অসুস্থ মনীষার সঙ্গে।
ম্যানহাটনে এর আগে অনেকবার এসেছি। এবারের মতো অনুভূতি নিয়ে কখনও নয়। বিশ্ববিখ্যাত স্লোন কেটরিং ক্যানসার সেন্টারে ঢুকতে ঢুকতে মনে হচ্ছিল যেন কোনও ফিল্মের সেটে ঢুকে পড়েছি। মনে হচ্ছে কোনও কিছুই রিয়েল নয়।
ফিল্মে যেমন দেখায়, নিজের মধ্যেও হঠাৎ করে একটা ফ্ল্যাশব্যাক এসে ধাক্কা দিল।
ঠান্ডা মেঘ আর ভেজা ধোঁয়া। খোলা আকাশ আর অনেক নাম না জানা ফুলের মাঝে ভেসে ওঠে এক অদ্ভুত গন্ধ। যার রূপ সরল-কৌতূহলী-স্বচ্ছ-শুভ্রতার প্রতীক।
সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ছে। যেন একটা পেঁজা তুলো আর ভালবাসার স্বপ্ন রাজ্য।
ভেজা মেঘ আর ধোঁয়াটে ঠান্ডা আমেজে একটা মুখ দেখতে পেলাম মনীষা।
জলের বিন্দুগুলো আটকে ঠোঁটের কোনায়। চোখের মধ্যে ঠান্ডা আমেজের ছোঁওয়া। সালোয়ার কামিজ পরা। লম্বা চুলে যেন পাহাড়ের রোদ। কপালের টিপ যেন ভোরের আলো। সকালের রোদে চোখের পাতার ওঠানামা। তাতেই দেখলাম কৌশানির মনীষাকে।
সেই মুখ, সেই চোখ, সেই অভিব্যক্তি। যা বিশ্বের দর্শককে মাতিয়েছে। মাতিয়েছে আমাদের মতো প্যাশনেট অভিনেত্রীদেরও। তারই নাম মনীষা কৈরালা।
পাহাড়ের গায়ে নতুন রোদের মতো হাল্কা সহজ তার তাপ।
ঘর আর ঘরে ফেরার ছোট ছোট রাস্তা দিয়ে এসে পৌঁছয় ‘ইলু ইলু গার্ল’। একটা প্রকান্ড সাঁকোর সে সামনে দাঁড়িয়ে। অপ্রতিরোধ্য তার আকর্ষণ। ‘আনমোল’ থেকে ‘গুড্ডু’। মণিরত্নম-এর ‘বোম্বে’র ওই সুরের মূর্ছনা কোথা থেকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল এই অপরূপ সৌন্দর্যকে। নেপালের বর্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে আর কাঠমান্ডুর অসাধারণ সৌন্দর্যের মধ্যে মিশে থাকা এই পাহাড়ি সুন্দরী জীবনের নিশ্বাস নেয় আরব সাগরের সমুদ্রের ফেনায়। যেখানে গড়ে ওঠে তার স্বপ্নের নগর। পাহাড় থেকে দূরে, মেঘের আর ভিজে ভিজে ধোঁয়ার আড়ালে। সেই জীবনে সে দেখল তার সারল্য, তার মন সব কিছু বদলাল। সেই নগরীর তালে তালে সেই নগরের নিজের চাহিদায়, নিজের তাগিদে। মনীষার সৌন্দর্যে মাতাল পুরো নগর। চোখের পলকে। আরব সাগরের রানি হয়ে উঠল সেই মোহিনী নারী যার পদক্ষেপে শাসন ছিল। ছিল ঔদ্ধত্য। ছিল সৌন্দর্যের মহিমা। আর অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা।
খান থেকে কপূর, দেবগন থেকে বচ্চন সবাই তার তাপে উজ্জ্বল হল। রাম গোপাল বর্মা থেকে মণিরত্নম, তার কাজের মহিমায় সবাই উদ্ভাসিত...
কিন্তু যত বছর পার হল, মনীষার মণির খনি থেকে কি অনেক ‘আনমোল’ রতন খসে পড়ল? খসে পড়ল ওর অনেক পরিশ্রম দিয়ে গড়ে তোলা এক আশ্চর্য সাম্রাজ্য?
সেই সাম্রাজ্যের কুলে যে অনেক মানুষ তার মনের হদিস পায়নি। যারা পেয়েছে, তারা হয়তো ওই নেপালি সুন্দরীর কদর করতে পারেনি। অনেক উপদ্রব আর মানসিক টানাপোড়েন চলেছিল ওই ললনার ওপর। যে শুধুমাত্র নানা পাটেকরের প্রেমেই উর্বর হয়নি। ভেঙে গিয়েছিল তার মন, তার প্রেমের ভাবনা।
|
|
যুবরাজের ব্যক্তিগত বার্তা |
... মনীষা, তোমার জন্য আমার বুকভরা শুভেচ্ছা আর সমর্থন রইল। আমি নিশ্চিত তুমি প্রচন্ড লড়াই করছ। আমার বিশ্বাস, এই যুদ্ধ তোমাকে আরও স্বাস্থ্যবান। মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী করে ফেরত আনবে। তোমাকে শুধু চেষ্টা করতে হবে সারাক্ষণ পজিটিভ থাকার। সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে চিকিৎসকদের ওপর আর ওঁরা যা ট্রিটমেন্ট দিচ্ছেন তাতে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কতগুলো দিন আসবে যেগুলো ভীষণ ভীষণ ডিপ্রেসিং। সহ্য করাই কঠিন। কিন্তু সেই সময় মনে রাখতে হবে, একেবারে ভাল হওয়ার জন্য ওই শক্ত দিনগুলো পার হয়ে আসাও জরুরি। বন্ধু, লড়াই করে যাও। হার মেনো না। আমিও তো ভুক্তভোগী। আমার দিক থেকে যাবতীয় প্রার্থনা থাকছে। মনীষা, দূরে বসেই যুবি তোমার জন্য চিয়ার করছে... |
|
পার্থ ঘোষের ছবি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ কি তাকে জীবনে বারে বারে দগ্ধিত করেছিল? দগ্ধিত করেছিল তার দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া-পাওয়া? সে ছুটে বেড়িয়েছে একটু ভালবাসার তাগিদে। কখনও কোনও নাইজেরিয়ান ফুটবলার, কখনও দেশের মাটির কোনও মানুষকে খুঁজে ফিরে। কিন্তু কে-ই বা পেরেছে সেই অতীব সৌন্দর্যকে আত্মস্থ করতে?
তাই কি সে ফিরে গিয়েছিল সেই পাহাড়ের কোলে তার প্রিয় জন্মস্থানে? যেখানে তাকে সিঁদুর পড়িয়েছিল তার দেশেরই কোনও মানুষ। যার হাত সে ধরেছিল গোপনে। সেই আগুনে শুদ্ধ হতে চেয়েছিল আরব সাগর স্নাত এই ললনা। কিন্তু কেন বারে বারে ভাগ্য তার সঙ্গে পরিহাস করেছে জানি না। বুঝতে পারি না। চোখের পাতায় যার শিশিরবিন্দুর অনুভূতি, চোখে যার প্রেমের চাঞ্চল্য, শরীরে যার এত উত্তাপ, মনে যার এত বিকাশ, কেন তার ভাগ্য বিরূপ হয় বার বার?
আমার সঙ্গে মনীষার দেখা হয় ‘সির্ফ’ ছবির শু্যটিংয়ে। আমি, কে কে মেনন আর পরভিন দাবাস মুম্বইয়ের এক তরুণ পরিচালকের ছবিতে। মনীষাকে দেখার উত্তেজনা সব সময়ই বুকের মধ্যে ছিল। ওর ঔজ্জ্বল্য ওর প্রতিভার মায়াতে বেশ বুঁদ হয়েই থাকতাম। ‘কুছ না কহো’র মোহ কাটানো অত সহজ ছিল না। আমার সহ-শিল্পী হিসেবে মনে হচ্ছিল ও কি সত্যি না মিথ্যে? আসল না নকল? লাল শাড়ির আড়ালে মুখে সামান্য ক্লান্তির ছাপ লক্ষ করেছিলাম ওর চেহারায়। মনে হয়েছিল ওর দৃষ্টিতে কোথাও বিষণ্ণতা আছে। মনে হয়েছিল ওর চোখের ডান দিকে যে ছোট একটা কাটা দাগ আছে সেখানে আছে অনেক নির্ভীকতা। ওর হাসিতে আছে আবেগ। হয়তো অনেক পথ পেরিয়ে ক্লান্ত, অবসন্ন সে। জানি না, কেন কথায় কথায় বেশ ভাল লাগল প্রিয় অভিনেত্রীকে। চোখের সামনে দেখলাম ওর বিগত বছরগুলো যেন ওর চোখের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। কী অপরূপ দৃশ্য তার। কী অনুভূতি! ভাল লাগল ওর সৌন্দর্য আর ওর প্রতিভার অদ্ভুত মেলবন্ধন।
এক দিকে ওর প্রতিভা, ওর অদম্য প্রাণশক্তি। আর অন্য দিকে জেনেছিলাম ওর উচ্ছৃঙ্খলতা।
এত দুঃখ কীসের ওর? কী ছিল তার রহস্য? কেন ঘুমোতে দেয়নি মানুষ ওকে অনেক দিন? কেন দিনের পর দিন ওর মনকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করছে? কেন সুরা আর ধূমপান ওর জীবনে নিত্যসঙ্গী হয়ে গিয়েছিল? কেন ওই কৌমার্যের ফোটা ফুলে একটু একটু করে রক্তবিন্দু জমা হয়েছিল? রক্তাক্ত হয়েছিল ও আঘাতে আঘাতে। অমানুষিক যন্ত্রণায়। আর কী পেতে চেয়েছিল হয়তো ও নিজেই জানে না। নিজেই হয়তো খুঁজে চলেছে। হাতড়ে বেড়াচ্ছে আজও ওই মেঘের আড়ালে আর নোনা সাগরের জলে।
‘ভাবনা আজ ও কাল’-এর একটা অনুষ্ঠানে মনীষা আর আমি মন্দারমণির জল আর বালিতে আবার আমাদের বন্ধুত্বের সাক্ষ্য রাখি। এই তো বছরখানেক আগে। যে চেহারায় আরও একটু কষ্ট জন্ম নিয়েছে। তবু সেই হাসিমুখ। সেই সুন্দর অভিব্যক্তি। কোনও বিরক্তি ছাড়াই সমস্ত সাংবাদিকের সঙ্গে অসাধারণ ব্যবহার। মুগ্ধ হয়েছিলাম দেখে। তা হলে কেন শুনি ও উৎচ্ছৃঙ্খল? মনে হয়েছিল সবটাই ভুল। সবটাই বাড়িতে ভুল চিঠি পৌঁছে যাওয়ার মতো। ও আমাকে হাত ধরে বলেছিল “ইউ আর ভেরি এন্টারপ্রাইজিং, ট্যালেন্টেড।” মনে হল এক অভিনেত্রীর সম্মান দান আর এক অভিনেত্রীকে। অদ্ভুত আনন্দ হয়েছিল।
প্রভাতদার ‘শ্বেতপাথরের থালা’র ‘মন থেকে মনে কী করে যে যাব’ আর ডি বর্মনের সুরে, গানটা হঠাৎ মসেই অপেক্ষায় রইলাম বন্ধু....
|
|
|
আজ আমার কেমোথেরাপির প্রথম দিন। অজানার ভয় আর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার
সাহসের মাঝখানে দুলছি। বাবা, মা, কোই, উলিয়ার সাহায্যের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছি।
সবার ভালবাসা আর প্রার্থনার জন্য ধন্যবাদ। ভালবাসার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হয় না।
২ জানুয়ারি ২০১৩, বেলা ৩.১৫, ফেসবুক |
|
|
|
|
|
|